শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে দেশে রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা থেকে প্রণোদিত হয়ে মিথ্যা মামলা দায়েরের প্রবণতা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে বলে অভিযোগ উঠছে। মানবাধিকার সংগঠন ও বিশ্লেষকদের মতে, ক্ষমতার পালাবদলের সুযোগ নিয়ে একশ্রেণির ব্যক্তি রাজনৈতিক বিরোধিতা, ব্যক্তিগত শত্রুতা বা অর্থনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য ভুয়া মামলা করছে। সবচেয়ে হতাশাজনক বিষয় হলো—এই প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কোনো অবস্থান নিচ্ছেন না নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
সম্প্রতি ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ার বাসিন্দা সোলায়মান সেলিম দাবি করেছেন, তাঁকে “মৃত দেখিয়ে” হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। পুলিশ তাঁর ঠিকানায় তদন্ত করতে গেলে তিনি নিজের নামে দায়ের হওয়া মামলার বিষয়টি জানতে পারেন। নিরাপত্তা হুমকির আশঙ্কায় থানায় জিডিও করেছেন তিনি। মামলাটি দায়ের হয় ঢাকার কাজলা এলাকায় গুলির ঘটনার পর, যেখানে প্রধান আসামি করা হয়েছে শেখ হাসিনাকে এবং অন্যান্য আসামির মধ্যে রয়েছেন ওবায়দুল কাদের, আসাদুজ্জামান খান কামাল, শামীম ওসমানসহ আরও ৪১ জন, পাশাপাশি অজ্ঞাত ১৫০-২০০ জন।
এছাড়া, খিলগাঁও থানায় কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় জেড আই খান পান্নার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া একটি মামলায় অভিযোগ করা হয় তিনি আহাদুল ইসলামকে গুলি ও মারধর করে হত্যার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু মামলার বাদী সংবাদমাধ্যমে স্বীকার করেন, তিনি পান্নাকে চেনেন না এবং মামলায় কারা আসামি তাও জানেন না।
এ রকমই আরেকটি ঘটনা ঘটে রবি দাস নামের এক মৃত ব্যক্তিকে নিয়ে, যিনি জুলাই মাসে মারা যান। কিন্তু মৃত্যুর চার মাস পর তাঁর নাম ব্যবহার করে মামলায় অভিযোগ তোলা হয় যে, তাকে আওয়ামী লীগ সমর্থকরা হত্যা করেছে। মামলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৪৫০ জনেরও বেশি ব্যক্তিকে আসামি করা হয়।
ফেনীতেও একই ধরনের মামলা দায়ের হয়, যেখানে জেলার আওয়ামী লীগ নেতা নিজাম উদ্দিন হাজারী এবং ঢাকায় বসবাসরত ব্যবসায়ী ইব্রাহিম পাটোয়ারীকে আসামি করা হয়। ইব্রাহিম জানান, তিনি সংশ্লিষ্ট সময় ও স্থানে ছিলেন না এবং এমনকি রাজনীতিতেও জড়িত নন।
মানবাধিকারকর্মী ও বিশ্লেষকেরা বলছেন, এসব মামলা মূলত রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন ও ভয় দেখানোর কৌশল। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, “একই মামলায় ২০০-২৫০ জনকে আসামি করলে প্রকৃত তদন্ত বাধাগ্রস্ত হয়, আর নিরপরাধরা হয়রানির শিকার হন।” তিনি বলেন, “এতে বিচারপ্রক্রিয়ার প্রতি জনগণের আস্থা ক্ষুণ্ন হয়।”
বিশ্লেষকেরা আরও সতর্ক করছেন, এসব কর্মকাণ্ড একদিকে যেমন প্রশাসনিক অনিয়মকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিচ্ছে, অন্যদিকে ন্যায়ের শাসন ও মানবাধিকারের মৌলিক ভিত্তিকে ভেঙে দিচ্ছে। তাঁদের মতে, ড. ইউনূসের মতো আন্তর্জাতিকভাবে সম্মানিত ব্যক্তিত্বের এ ধরনের অন্যায় ও রাজনৈতিক হিংসার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তাঁর নীরবতা জনমনে বিভ্রান্তি ও ক্ষোভের জন্ম দিচ্ছে।
এ পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থায় দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা করছেন তাঁরা।
Leave a Reply