নিউজ ডেস্ক, জাপান: আহমেদ মাহফুজুল হক, আমাদের প্রিয় জাহাঙ্গীর ভাই।
বহুকাল আগে ‘সুবর্ণ’ থেকে প্রকাশিত হয় আমার লেখা একটি গদ্য। এটি লেখার সময়, কম্পিউটারে প্রিন্ট তুলছি। তিনি এলেন। আমি হাতের কাজ সারতে সারতে দেখি তিনি গদ্যটি প্রায় পড়ে ফেলেছেন নিমিষেই। অনেক প্রকাশক খুব দ্রুত পড়তে পারেন, তাদের পড়ার জগতও খুব বিস্তৃত!
‘পুরোটা কবে কম্প্লিট করতে পারবেন?’
-জানি না স্যার! ইলেমেন্টের অভাব। নাগালে নেই। বই আনিয়েছি বিলেত থেকে। ওটা গবেষণা। খটমটে! এখানে খাটে না।’
তিনি ২০০০ টাকা সেই গদ্যটির সাথে স্টেপলার পিন করেন।
‘এটা আমি নেবো।’
অবাক হয়ে যাই। এটা লেখকের অগ্রীম, প্রকাশকের কাছ থেকে! সচরাচর দুর্লভ ঘটনা বটেই! ভাবনায় পড়ি, সাম্প্রতিক অর্থকষ্টের খবর তিনি রাখেন নিশ্চয়ই, যেহেতু তিনি আমার সব খবর রাখেন! এটা কি সেজন্যে, নাকি লেখাটা সত্যিই ভালো?
: আমি ফেব্রুয়ারির আগেই দেবো স্যার! প্রুফ দেখিয়ে দেবো। নিশ্চয়ই দেবো স্যার।-কী বলবো ভেবে পাচ্ছি না! এটা এতো দুর্লভ ঘটনা যে, যারা লেখালেখি করেন তারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, এখানে বিশুদ্ধ স্নেহ ছাড়া আর কোনো কারণ থাকতেই পারে না!
‘জানি তো, এই লেখাও শেষ হবে না কোনোকালে!’ হাসেন তিনি। ‘অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, মাঝপথে মরে যাবে আপনার লেখা। তবুও যতটুকু লিখেছেন এবং লিখবেন, অথবা যা লিখেছেন ততটুকুই…. জাস্ট ছেপে দেবো! দায় তো আপনার! বইয়ে রাইটারের নামটা যাবে, আপনার।ব্যাড রাইটার, গুড রাইটার দুটোই আছে। লেজি রাইটারও আছে!’
এহেন ভবিষ্যতবাণী শুনে আহত ও কাতর চোখে তাকাই স্নেহময় সিনিয়রের দিকে। মৃদু হেসে বলেন,–‘ডায়োজেনেসের উপর ছোট্ট একটা অ্যানেকডোটসের বই তো হতেই পারে। প্রকাশনা মানেই মোটা বালিশ হতে হবে, এমন তো কথা নেই!’
তার কথা অক্ষরে অক্ষরে ফলেছে! ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ওটা ছুঁযে দেখবার সময় হয়নি। তিনি ফেব্রুযারির প্রথম সপ্তাহে একদিন বলেন-যেটুকু আছে তাই গুছিয়ে দিতে। যথাসম্ভব পালন করি তার আদেশ।জাহাঙ্গীর ভাই নিজে প্রুফ কেটেছেন, গেট্আপ মেকাপ দেখেছেন, এবং সবশেষে বইটি হলো মাত্র এক ফর্মার! ৩২ পৃষ্ঠার পকেটবুক!
বইটি ছাপা হয়েছে ৫০০ কপি।
ডায়োজেনেস।
লেখক আহমেদ মাহফুজুল হকের ইচ্ছায় প্রথম গদ্য প্রকাশ পেলো আমার।!
এরপর?
প্রথম সংস্করণ শেষ। এককপিও নেই, আমার কাছে কিংবা প্রকাশকের ঘরে। সবচেয়ে মজার বিষয়, বইটি বিক্রয় হয়েছে মাত্র ২৪ কপি। বিক্রয় নয় যেন বা বিতরণের নিমিত্তেই বইটি ছেপেছেন প্রকাশক।’ডায়োজেনেস’ প্রথম সংস্করণের প্রায় সব বই সৌজন্য কীবা উপহার হিসেবেই বিতরণ করা হয়েছে সুবর্ণ প্রকাশনের স্টল এবং কাউন্টার থেকে!
ভাবলে চোখ ভিজে যায়… তিনি আমার সামনে ছোট্ট ওই বইটা তাঁর বন্ধুদের মাঝে বিলিয়ে দিচ্ছেন, আর বলছেন… ও ডায়োজেনেসকে পরিচয় করিয়ে দিলো এবার… আরো লিখবে। এটা আবার লিখবে ও।” তার বন্ধুরা সবাই জাতীয় মেধা। এই জাতি গঠনের কারিগর। আমার ওই ছোট্ট লেখাটুকু তিনি সবাইকে পড়িয়েছেন। মেলায় স্টলে বসেই পড়ে ফেলেছেন কেউ কেউ ওই ৩২ পৃষ্ঠা! এবং ব্যাগে করে নিয়ে গেছেন!
এবার একটু আসি, বাংলাবাজারের ইতিহাস নিয়ে।
যাদের ইতিহাসে আপত্তি, তাদের বলি, ইতিহাস জানতেই হয়, বর্তমানটা বুঝতে গেলে।
বাংলাবাজারের ইতিহাস জাতিসত্ত্বা গঠনের সাথে জড়িত! এ নিয়ে আমার একটু গর্ববোধ আছে।
মাওলা ব্রাদার্স, খান ব্রাদার্স এবং স্টুডেন্ট ওয়েজ আমার জানামতে বাংলাবাজার, মানে পূর্ব পাকিস্তানের এবং পরে বাংলাদেশের সৃজনশীল প্রকাশনার অন্যতম ৩ পথিকৃত প্রকাশক। যারা এই প্রকাশনাগুলির প্রতিষ্ঠাতা, মোস্ট সিনিয়র প্রজন্ম, তাঁদের আমি পাইনি। বাবা পেয়েছেন তাঁদের। কিন্তু তার পরবর্তী প্রজন্ম, সুবর্ণ-এর জাহাঙ্গীর ভাই , খান ব্রাদার্স ফিরোজ খান ভাই এবং স্টুডেন্ট ওয়েজ-এর লিয়াকত ভাই (তারা দু’জন আমার বাবারও ভাই ছিলেন!) তাদের অপার স্নেহ পেয়েছি। সুবর্ণ মূলতঃ মাওলা ব্রাদার্সের ডটার কনসার্ণ।
এই প্রতিষ্ঠানগুলি বাংলাদেশের সৃজনশীল সাহিত্যের বিকাশে অনবদ্য অবদান রাখার দাবী তুলতে পারে অনায়াসেই। এঁরা আমার কাছে আর্কাইভ। ঘটনাবহুল বাংলাবাজারের এবং বাংলাদেশের। যার একটা দু’টো ঘটনা না বললেই নয়।
১. ফিরোজ খানের বাবা __ প্রতিষ্ঠা করেন খান ব্রাদার্স। হুমায়ূন আহমেদের ‘নন্দিত নরকে’ ও ‘শঙ্খনীল কারাগার’ তিনিই প্রথম ছাপেন। লেটার প্রেসে ছাপা হতো তখন। এখনকার মতো বইয়ের মেকাপ ঢেলে সাজাবার সুযোগ নাই। সীসার টাইপের সাইজ মনে লিখতে হয়।
১৬ পৃষ্ঠায় ১ ফর্মা। বইয়ের পৃষ্ঠাসংখ্যা অবশ্যই ৮ বা ১৬ দ্বারা বিভাজ্য হতে হয়। সেই হিসেবে, বইটি কম্পোজ করার পর দেখা গেলো… ১১ পৃষ্ঠা কম পড়েছে। জানানো হলো লেখককে। তিনি বাংলাবাজারে প্রেসের ভেতরে ম্যানেজারের রুমে স্যান্ডো গেঞ্জি পরে বসে গেলেন।১১ পৃষ্ঠা লিখলেন। পৃষ্ঠা মিলিয়ে তৈরি হলো তার যাত্রা শুরুর উপন্যাস। ১ম প্রচ্ছদ বোধ করি শামীম সিকদার করেছেন। ছফা ভাইয়ের মন্তব্য ছিলো…. “তারে ভাস্কর্যেই মানায়। এইটা না করলেও চলে তার!” এনিওয়ে, হুমায়ূন আহমেদের লেখকমুরতির নির্মাতাদের প্রথম ব্যক্তি জনাব খান।
হুমায়ূন আহমেদ আত্মজীবনীতে লিখলেন, জনাব খান তার প্রচ্ছদ আনতে কাইয়ুম চৌধুরী কাছে গেলে শিল্পী তা ঘোরাতে থাকেন এবং এক পর্যায়ে জনাব খানের পেছনে কুকর লেলিয়ে দেন! ফিরোজ খানের ছোটো ভাই, জনাব খানের কনিষ্ঠ পুত্র হুমায়ূন আহমেদকে প্রশ্ন করেন… এমন ঘটনা কবে ঘটলো? কা্ইয়ুম চৌধুরী এবং বাবা, দুজনে বন্ধুর মতো ছিলেন!
লেখক হেসে জবাব, লিখতে গেলে একটু রং চড়াতে হয় ভাই!
২. আহমেদ মাহফুজুল হক একজন সুলেখক। তিনি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন দীর্ঘকাল। তরুণবেলা থেকেই রাজনীতির সাথে জড়িত। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে মেধাযোদ্ধা তিনি। সুবর্ণ প্রকাশনার বইয়ের তালিকাই প্রমাণ করে প্রকাশনার মেরিট!
মাহমুদ ভাই, মাওলা ব্রাদার্সের কর্ণধার, প্রকাশক। তার বইয়ের তালিকাটা একটু দেখলে অবাক হতে হয়! অনেককাল আগে যখন আহমদ ছফার কোনো একটি বই ছাপবেন তিনি, কোনো এক বিতর্কিত বা ঝুকিপূর্ণ বক্তব্যের সম্পাদনার জন্য অপেক্ষা করছেন। অন্যদিকে তখন বাজারে কাগজের কৃত্রিম সংকট। বই ছাপতে দেরি হচ্ছে।
আহমদ ছফা ভাবলেন, মাহমুদ ভাইয়ের সম্ভবত কাগজ কেনার পয়সায় টান পড়েছে।
তিনি তাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘মাহমুদ, তোমার কি টেকাপয়সা লাগবো?’
বেচারা ছফা খুব স্নেহ করেন তরুণ প্রকাশককে। কিন্তু এখানে মাহমুদ ভাই ‘উল্টো বুঝলি রাম’ অবস্থা! তিনি ভাবলেন, আহমদ ছফা মীন করেছেন, তিনি পয়সা ছাড়া বই ছাপবেন না! এটা হতেই পারে। বাজারে ট্রেণ্ডও আছে এমন! রবিঠাকুর নিজের পয়সায় বই ছাপতেন! কিন্তু প্রকাশক খুব আত্মসম্মান সচেতন মানুষ।
“কী বললেন আপনি! আপনার কাছে টাকা চাইবো আমি! এর মানে কি?” মহাক্ষেপা ক্ষেপে গেলেন তিনি! আহমদ ছফা তাড়াতাড়ি কথা না বাড়িয়ে রাস্তার চলন্ত খালি রিকশায় ওঠেন লাফ দিয়ে! রিকশাঅলা গন্তব্য জানতে চাইলে বলেন, সামনে আগাও মিয়া! অয় ক্ষেপছে!
মাহমুদ ভাই বাংলাবাজারে হরহামেশাই বলেন, ‘একজন প্রকাশক যখন বই ছাপে তখন সবার বাজেট থাকে তার। কাগজ, প্রেস, বাঁধাই, শিল্পী এবং লেখক, সবার জন্যই নির্ধারিত বাজেট করে নামেন প্রকাশত বই ছাপতে। এটাই তো দেখি। টাকা ছাড়া কেউ বই ছাপতে আসে না। টাকা নিয়েই নামে প্রকাশক। তাহলে পেমেন্ট নিয়ে বা রয়েলিটি নিয়ে ঝামেলা বাঁধে কেন?’
আমিও ভেবেছি। তাই তো! তাহলে সমস্যা কোথায়? এর জবাব আজো খুঁজে পাইনি!
এই পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ ভাই, সুমন, তার সাথেও আমার বেশ ভালো খাতির। সুমনের প্রকাশনার নাম ‘উত্তরণ’। এটাও মাওলা ব্রাদার্সেরই ডটার কনসার্ণ। সুমন খুব ভালো দাবা খেলে। এখনো দোকানে দাওয়াত করে তার সাথে দাবার বোর্ড বিছিয়ে বসবার জন্য। “আসুন তবে ভাই, হয়ে যাক এক হাত!”
জাহাঙ্গীর ভাইয়ের বাসায় বহুবার অন্নগ্রহণ করেছি আমি। ভাবী, তার কাজিন ছিলেন একদা, বাংলাবাজারেই বড় হয়েছেন, খুব স্নেহ করেন আমায়। দু’জনে প্রেম করে বিয়ে করেন। একদিন বেশ কিছু বাড়তি টাকা পেয়ে গেলে একটা শাড়ি কিনে উপস্থিত হই তাদের নিবাসে।
“শিল্পী, এটা কি হইলো? আমাকে আপনি জীবনে কি দিয়েছেন? ও আপনাকে দুইদিন ভাত খাইয়েছে, আর আপনি… আমি তো আপনাকে টাকা দিযেও কিছুই পাই না! আপনি তো অসম্ভব একটা মানুষ!” তিনি কপট রাগে গজগজ অভিনয় দেখাচ্ছেন।
: পায়ের ধুলা নেবো, প্রণামী দেবো না?- হেসে কই তারে।
“এইটা কোনো যুক্তি হলো। সারাদিন বাইরে রাস্তায় হাঁটাহাটি করি আমি, আর ও তো ঘরেই থাকে। ওর পায়ে ধুলা লাগে? আমার পায়ে কী ধুলার অভাব শিল্পী?”
তখন সহাস্য বলি অথবা গেয়ে উঠি… আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণধুলার তলে!
কোনো একদিন….
‘জীবনের সেরা প্রচ্ছদটা দিতে পারবেন?’ স্যার প্রশ্ন করেন।
প্রশ্নটা না বুঝে তাকিয়ে থাকি তার দিকে।
‘আমার জীবনের পড়া সেরা বইয়ের একটা। মানতিকুত তোয়ায়ের। পাখিদের কাহিনী। ফরিদউদ্দীন আত্তারের। পারবেন।”
: স্যার সী মোরগের গল্পটা জানি। আমি চেষ্টা করছি।
“জানি গল্পটা জানেন। আমি আলাদা কিছু করতে চাই। এমন কি ভিন্ন কাগজে ভিন্ন প্রযুক্তি হলেও অসুবিধা নাই।”
আমি করে দিয়েছি তার কাজ। মনোপুতঃ হয়েছে তার।
সুবর্ণ প্রকাশনে আমার কোনো হিসাবের খাতা নেই! যা কাজ হতো তার অনেক বেশি মজুরি দিতেন তিনি। জীবনে প্রকাশক আহমেদ মাহফুজুল হকের সে প্রশ্রয় পেয়েছি তা অমূল্য!
Leave a Reply