বইপাড়া
বাংলাবাজারের বইপাড়া গড়ে ওঠার পেছনে একটা ছোট্ট রাজনৈতিক ইতিহাস আছে। যখন ঢাকা মানেই পুরোনো ঢাকা, যখন নতুন ঢাকার ধানমণ্ডি উত্তরার জনবসতি বিরল বলে ওই দুটো জায়গা ঢাকার অংশ নয়, মিরপুরে তখন সবে বসতি শুরু হলেও চিড়িয়াখানাটা করা হয়েছে ঢাকার বাইরে, মিরপুরে। স্বাধীনতার অনেক পরে, সম্ভবত ১৯৭৬ সালে ‘নীল আকাশের নীচে’ নামে একটা চলচ্চিত্রে দেখি, নায়করাজ রাজ্জাক ভার্সিটিতে পড়েন, গ্রামের ছেলে।
হঠাৎ উধাও হলে বান্ধবী জানতে চায় সে কোথায়! বন্ধুরা জবাবে বলে, “ও তো এখন ঢাকায় থাকে না, ঢাকার বাইরে মফস্বলে থাকে। জুরাইনে। শুনেছি বেবিটেক্সি চালায়।” পৈতৃক ভিটা বাড়িটি জুরাইনে (ছিলো) বলে এই উদাহরনটা জানি। বাংলাবাজারের স্থানীয় বন্ধুরা বলতো, তুই তো মফস্বলের ছেলে! এই এলাকায় আমার স্কুল, এবং কর্মক্ষেত্র। পুরো জীবনটা এই কয়েক স্কয়ার মাইলের গণ্ডিতেই কাটলো তবে? বাংলাবাজার গড়ে ওঠার ওই সময়টা গুরুত্বপূর্ণ।
এদেশে সম্ভবত ১৯৫৫-৫৬ সালে পুরোনো ঢাকার মূদ্রণ ব্যবস্থা একটু স্বনির্ভর হতে শুরু করে। লেটার প্রেসের টাইপ তৈরির ফাউন্ড্রি ওই সময়েই ঢাকায় চালু হয়। আগে বাংলা টাইপ কলিকাতা নির্ভর ছিলো। এই সময়ে অনেকগুলি প্রেস গড়ে ওঠে। একটা বিষয় অবশ্য নিশ্চিত নই, এদেশে ধর্মীয় পুস্তক ছাপা হতো সবসময়ই। কিন্তু কোরআনের কলিকাতা হরফের পাশাপাশি আমাদের বাংলাদেশী আরবী হরফের কোরআনের প্রচলন ঠিক কবে থেকে।
জানি, জেনে যাবো। প্রেস ও কাগজ যখন সুলভ হতে শুরু করে তখনই গড়ে ওঠে বাংলাবাজার। সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে এই বইপাড়ার গুরুত্ব অপরিসীম। তখন শহুরে মানুষের একমাত্র বিনোদন মাধ্যম, বই পড়া আর সিনেমা দেখা। সুতরাং শিক্ষিত জনতার জন্য শিক্ষিত ব্যবসায়িক বিনিয়োগ এই দুই ক্ষেত্র। ওই সময়ে একটা মুদ্রণালয় বা প্রেস থাকা মানে ধন্যাঢ্য আভিজাত্যের প্রমাণ। এদেশে কলকাতা থেকে বাংলা বই আসতো। পত্রিকা আসতো।
এদেশের মানুষ পাল্প, ফিকশন আর থ্রিলারজাতীয় পপ-লিটারেচার পড়তো কলকাতার লেখকদের লেখা। নীহাররঞ্জন মিত্র, ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়, বিমল মিত্র ইত্যাদি। স্বাধিনতার আগে এরকম উপাদান এদেশে লেখা ও ছাপা হতো না। অল্প সংখ্যক প্রেস। বেশির ভাগই টেক্সটবুক আর রেফারেন্স বুক ছাপেন তারা। আর ধর্মীয় বই। ধর্মীয় বইয়ের বাজার সব সময সব দেশেই সদা সচল। বাংলাবাজারে বিক্রি হয় কলকাতার সব বই।
ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হলে, এবং তার পরে কয়েক বছর ভারত থেকে বই আমদানী নিষিদ্ধ হলো। তখন এক অচলাবস্থা তৈরি হবার উপক্রম হলো। এদেশে দুই তিন বছর পরই পাল্প, ফিকশন আর থ্রিলার জাতীয় বইযের টান তো পড়লোই, ভালো গল্প উপন্যাসের বইয়ের অভাব তীব্র হয়ে উঠলো। বিষয়টা স্বাভাবিক। এই দুই দেশের এই বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীকে সীমান্তে আলাদা করা গেলেও অনুববে আলাদা করা সুযোগ কম। সুতরাং…. এই দুরাবস্থা নিরসনে এগিয়ে এলো পাকিস্তান সরকার। বাংলাবাজারে প্রেসের মালিকদের বলা হলো, কপিরাইট আইনের গুল্লি মারো।
আমরা কাগজ দিচ্ছি বাকি, (যা পরে কাউকে ফেরত দিতে হয়নি) তোমরা যে যা পারো ছাপো! আমাদের দেশে কর্ণফুলী হোয়াইট শেষ হলে পাকশী নিউজপ্রিন্ট মিলের ভাণ্ডার খুলে দেয়া হলো। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে একটা টুকরা কাগজ দেয়নি তারা। ফলে নিউজপ্রিন্টে ছাপা হলো কড়ি দিয়ে কিনলাম, রক্তমুখী নীলা বা সাহেব বিবি গোলাম! সুনীল-শীর্ষেন্দু-সমরেশ তখন কেউ তেমন চেনে না। েরা অনেক পরে এসেছেন। তখন একটা বই ছাপা এতো সহজ ছিলো না। সেটা কপি ছাপাো ছিলো সুকঠিন। কারণ ওই সময়ের প্রযুক্তি। আজকাল তো একটা ভালো ফটো কপিয়ার হলেই যে কোনো বই ৫০ থেকে ৫০০ কপি ছেপে ফেলেন প্রকাশক। তখন পুঁজিও বিরাট একটি বিষয়। প্রেস মানে টনকে টনকে শীসার টাইপ।
একটা বইয়ের পুণঃমূদ্রণও শুধু চাহিদার সাপেক্ষেই সম্ভব। বই ছাপার পর টাইপের বিন্যাস ভেঙে রিসর্টিং করতে হয পরের বই ছাপতে! ওই অবস্থায় সরকারী সহায়তায় দাঁড়িয়ে গেলেন কিছু পুস্তক ব্যবসায়ী। বিরাট একটা পুঁজি পেয়েছে এদেশের ভিয়ের বাজার। স্বাধীনতার পর আরেকটা বিরাট রাজনৈতিক বিনিয়োগের খেলার ভিতর গেছে বাংলাবাজার। তখন বিশ্বে সোভিয়েত ব্লক আর মার্কিন ব্লক ভাগাভাগির সময়। তায় আবার নতুন শক্তি, চীন।
তাদের মাওবাদী চেতনার প্রচার চলছে বিশ্বজুড়ে। বাংলাভাষী পন্ডিতদের বিশেষ রিকুইজিশন করঝেন তারা। নিয়ে যাচ্ছেন তাদের দেশে। ওখানে বাংলা ভাষায় তাদের সাহিত্য এবং রাজনৈতিক ভাষ্য মূদ্রণ করে এদেশে পাঠাচ্ছেন ওই মতাদর্শের রাজনীতিবিদ প্রকাশকদের মাঝে। বাংলাবাজারে ওই সময়েই রাজনৈতিক মতাদর্শের সূতিকাগার হযে ওঠে। আমাদের দেশের সেরা বইগুলোও ওই সময়ে লেখা হয়, ছাপা হয়। সোভিয়েত রাদুগা ও প্রগতি প্রকাশনী আর চীনের রাষ্ট্রীয় প্রকাশনীর কোটি কোটি টাকার বই আসে বাংলাবাজারে, পুরানা পল্টনে এবং কিছু বই চট্টগ্রামে।
এসব বই বিনামূল্যে বিতরণের জন্য বরাদ্দ ছিলো। কিন্তু প্রথমে কিছু বই বিনামূল্যে বিতরণ হলেও পরে…. বাংলাবাজারে থাকি। লেখকরা আসেন। তাদের লেখা ছাপতে সহায়তা করি। বই বাজারে আসার একটা সময় অভিযোগ শুনি, ভাই প্রকাশক তো কিছুই দিলো না। ঘনিষ্ট জনকে বলে ফেলি, সব দেশেই প্রকাশক শ্রেণি মধ্য সত্ত্বভোগী। তাদের দুইদিক থেকেই নেয়ার অভ্যাস। দেয়ার অভ্যাস থাকে খুব কমসংখ্যক প্রকাশকের। এদেশে এখন অবস্থাপন্ন প্রকাশক হাতে গোনা। প্রকাশনা ও মূদ্রণশিল্প এদেশে শিল্প হিসেবে কখনোই মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি পুঁজির অভাবে। তবে, এদেশের অন্য পুঁজি ছিলো, আছে, থাকবে।
তা হলো মেধার পুঁজি! ওটা এদেশে যেদিন মূল্য পেতে শুরু করবে তখনই ভিন্নচিত্র দেখবো আমরা। কোনোদেশেই প্রকাশকরা লেখকের রিয়ালিটির বিষয়ে সৎ হতে পারেন না। এদেশে প্রকাশনার জোযার যকন াসে তকন তাদের মাথায় ছিলো… লেখকের পয়সা দিতে হয় না। কাগজ প্রেস বাঁধাই খর্চা দিলেই চলে। ভারতের লেখকের পয়সা কেউ দেয়নি। দিতে গেলে সরকার জেলে পুরে দেবে তাকে। ওই মানসিকতা রয়ে গেছে এখনো। দুই প্রজন্ম পরেও তেমন উন্নতি হয়নি। বাংলাবাজারের পেট চলে নকল বই বিক্রি করে। এবং নাই নাই উপন্যাসের গল্পটা এখানে না বররেই নয়! নকল বই ছাপা ও বিক্রির একটা নেটওয়ার্ক সব দেশেই থাকে। তবে ভারত ও বাংলাদেশের নকল বই প্রস্তুতকারকরা একেকজন জিনিয়াস!
এটা সম্ভব হযেছে প্রযুক্তি সুলভ হবার কারণে। সুনীলের ‘একুশ বছর বয়সে’ উপন্যাসটি আর শীর্ষেন্দুর ‘তিন জন যুবক ও একটি নারী’ দুটো বই কিনে দেখলেন, একী! দুটো বই হুবহু এক কেন? হবে না? ধরুণ, একুশ বছর বয়সে উপন্যাসটি ৪ জন ছেপেছেন। তার মধ্যে তিনজন বাজারকে খাইয়ে ‘সম্পৃক্ত’ করে ফেললেন, মানে এখন বাজারে আর ওটার চাহিদা নাই। তখন চতুর্থজন যিনি বেচতে পারেননি তার জিনিয়াস আইডিয়া প্রয়োগ করবেন! শীর্ষেন্দুর নামে কভার আর ইনার ছেপে পুনরায় বাইন্ডিং করবেন। ব্যাস! বাজারে শীর্ষেন্দুর নতুন উপন্যাস এসে গেলো একটা।
বলা বাহুল্য, এ রকম কযেকটা বইযের মলাট আমিও করেছি। পরে জেনেছি ওই নামে কোনো গ্রন্থই কেউ রচনা করেননি কোনোদিন! সমরেশ মজুমদার এ দেশে ঘুরে কলকাতা গিয়ে বলেন, আমার অবস্থা হয়েছে শংকরের মতো…. শংকর বলেন, আমি নিশ্চয়ই বড়ো লেখক হযে গেছি কারণ আমার নামে এমন বই দেখলাম ফুটপাতে যেটা অটোমেটিক লেখা হচ্ছে! ঢাকার ফুটপাতে দেখলাম আমার লেখা এমন সব উপন্যাস যার নামও আমি শুনিনি! বাংলাবাজার, ঢাকা ৩ মে ২০২৪
Leave a Reply