নিউজ ডেস্ক, ঢাকা: ২০২৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর,রাশিয়া তাদের নিয়মিত প্রেস ব্রিফিং-এ বাংলাদেশকে নিয়ে এক বিষ্ময়কর তথ্য দেয়।
রাশান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া যাখারোভা সে ব্রিফিং-এ পরিষ্কারভাবে বলে দেন যে, আসন্ন নির্বাচনে যদি আওয়ামীলীগ জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে তাহলে আমেরিকা এই সরকারকে হটাবার জন্য সব রকমের চেষ্টা করবে।
সব রকমের চেষ্টার কথা বলতে গিয়ে যে কয়টি চেষ্টা মারিয়া উল্লেখ করেন তার মধ্যে আশ্চর্যের ব্যাপার ছিলো ইউনিভার্সিটি-কলেজ-স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের মাধ্যমে একটা ‘এরাব স্প্রিং’ জাতীয় ঘটনা ঘটাবার ব্যবস্থা করা।
ঐ একই বছর অগাস্ট-এর ৯ তারিখে ইনসেপশন নামের একটি ওয়েবসাইট ফাঁস করে দেয় যে ইমরান সরকারের পতনের পেছনে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রনালয়ের সহকারী সচিব ডোনাল্ড লু, যিনি মার্কিন প্রশাসনের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়গুলো দেখেন, তিনিই মূল মাস্টার মাইন্ড।
ইনসেপশান সাইটটি তাদের প্রতিবেদনে ডোনাল্ড লু’র নানাবিধ মেসেজ চালাচালি প্রকাশ করে দেন যেখানে দেখা যাচ্ছে ডোনাল্ড লু বলছেন-
“people here and in Europe are quite concerned about why Pakistan is taking such an aggressively neutral position (on Ukraine), if such a position is even possible. It does not seem such a neutral stand to us.” Lu added that he had held internal discussions with the U.S. National Security Council and that “it seems quite clear that this is the Prime Minister’s policy.”
ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর সাথে সাথেই ইমরান খানের রাশিয়া সফর, জাতিসঙ্ঘে প্রকারান্তরে/আনেবানে রাশিয়ার পক্ষে অবস্থান নেয়া এ-সমস্ত কিছুই ওয়াশিংটন অপমান হিসেবে নিয়েছিলো।
ফলে তারা ইমরান খানের সরকারকে ফেলে দিতে দেরী করেনি। আর এই পুরো প্রক্রিয়ার মাস্টার মাইন্ড বা সমন্বয় করেছিলো ডোনাল্ড লু নিজেই।
ডোনাল্ড লু’র প্রায় ৩১ বছরের পুরোনো বন্ধু পিটার ডি হাস; যিনি এতদিন বাংলাদেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূত হিসেবে ছিলেন।
পিটার হাসকে যখন বাংলাদেশে নিয়োগ দেয়া হয় তখন তার উপর স্পেশাল এসাইনমেন্ট ছিলো ইন্দো প্যাসিফিক রিজিয়নে চায়নার প্রভাবকে হ্রাস করা এবং বাংলাদেশকে সদস্য কিংবা স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার হিসেবে যুক্ত করা।
জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিঞ্জো এবে’র উদ্ভাবিত’ ‘কোয়াড’ জোটের অংশীদার হিসেবে বাংলাদেশকে নিয়ে আসবার জন্য পিটার ডি হাসের চেষ্টার একদম কমতি ছিলোনা।
কিন্তু পীতম্বর বা পিটার যে পুরো সময়টা বাংলাদেশে ছিলেন, তাকে বাংলাদেশের সাথে চায়নার সবচাইতে ঘনিষ্ট সম্পর্কের মূহুর্তগুলো দেখে যেতে হয়েছে।
দূর থেকে তিনি হয়ত ক্রোধান্বিত হয়েছেন কিংবা ফুঁসেছেন কিন্তু দিনের শেষে তিনি এর বিরুদ্ধে ভিলেইন হিসেবে তেমন সাফল্য পান নি।
বাংলাদেশে নির্বাচনের আগে কয়েকবার এসেছিলেন ডোনাল্ড লু। নানাবিধ চেষ্টা চরিত্র করেছিলেন ইলেকশন নিয়ে। সাফল্য পাননি। আমেরিকা সাধারণত ফরেন পলিসিতে অপমান মনে রাখে। ব্যার্থতাগুলো সহজে ভোলে না।
লু আর হাস তথা মার্কিন প্রশাসনের কাছে বাংলাদেশ এখন পরাজয়ের নাম। এই ডিপ্লোম্যাসিতে তারা পরাজিত হয়েছে। ফলে প্রতিশোধের আগুন বাংলাদেশ বহু আগ থেকে টের পেয়ে যাচ্ছে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রায়ই পরোক্ষভাবে তাঁর মৃত্যুর কথা বলেন। মৃত্যুকে তিনি ভয় পান না বলেন। কেন এসব কথা বলেন, আমরা এখন তা বুঝতে পারি।
বাংলাদেশের সাথে চায়নার যে সম্পর্ক; সেটি নিয়ে আরেকদিন বলা যাবে কিন্তু এই সম্পর্ক মার্কিনিরা মেনে নেয়নি সে কথা বলা বাহুল্য মাত্র। ভারত যে এই সম্পর্ক নিয়ে আনন্দিত ছিলো, তা একেবারেই নয়।
কিন্তু ভারত; বাংলাদেশের সাথে নানাবিধ সম্পর্কে জড়িয়ে আছে এবং এই সরকারের মাধ্যমেই ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক আরো সুনিবিড় হয়েছে, ফলে চায়নার সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক মেনে নেয়া ছাড়া উপায় ছিলোনা। সবাই সবার স্বার্থ ঠিকি বোঝে।
মার্কিনিরা কোনোভাবেই বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতায় চায়নি। এই না চাওয়া শুধুমাত্র মার্কিনিদের যে চাওয়া-পাওয়া বাংলাদেশের প্রতি তা পূরণ না হবার কারনেই।
এখানে বাংলাদেশের জনতা, গণতন্ত্রের বুলি, সুশাসন এসবের সম্পর্ক নেই। এগুলো মার্কিনিরা বলে তাদের মূল ইচ্ছেকে বা ধান্দাকে লুকোবার জন্য।
যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম।
রাশিয়া ১৫ ডিসেম্বর ২০২৩ সালে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিলো যে নির্বাচনের পর বাংলাদেশে ছাত্র-বিক্ষোভ হবে এবং আরব বসন্তের মত অবস্থা তৈরী হবে।
জুলাইতে এসে এই বিক্ষোভের দেখা আমরা পেলাম।
এর আগে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সি আই এ তাদের সমস্ত সহযোগীদের মাঠে নামাবার প্রস্তুতি সম্পন্ন করে দিয়েছিলো। এই সহযোগীরা কেউ কেউ প্রতিষ্ঠান, কেউ কেউ ব্যাক্তি, কেউ সংঘ।
এর আগে আমি আমার লেখায় মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার সিস্টার কনসার্ন ন্যাশনাল এন্ডৌমেন্ড ফর ডেমোক্রেসির কথা অনেকবার বলেছি। যারা নেত্র নিউজ নামের তাদের একটি বাংলাদেশি ভার্সনে প্রোপাগান্ডা মেশিন বাজারে ছেড়েছিলো।
এই ছাড়াও তাদের অপারেট করা অনেক ব্যাক্তি, সংগঠন, পত্রিকা বাংলাদেশে অনেকটা ওপেন সিক্রেট ভাবে অপারেট করছে।
মজার ব্যাপার হচ্ছে রাশিয়ার দেয়া ১৫ ডিসেম্বরের সেই বিবৃতি রাশা তার রাষ্ট্রীয় ওয়েবসাইট থেকে মুছে ফেলেছে। যদিও এই বিষয়ে মার্কিনিরা প্রতিবাদ করেছিলো এবং এগুলোর সাথে তাদের সম্পর্ক নেই বলে জানিয়েছিলো।
সে সময় বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী আব্দুল মোমেনও রাশার এমন তথ্যকে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। যদিও তিনি সেটা কেবল বলার জন্য বলেছিলেন বলে ধারনা করি
আপনাদের যে জিনিস এখানে লক্ষ্য করবার রয়েছে তা হচ্ছে ঘটে যাওয়া পুরো ঘটনা।
মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা কিভাবে কোটার বিষয়টিকে নজরে রেখেছিলো। কিভাবে আদালতে দায়ের করা রিটের দিকে নজর রেখেছিলো। এবার কি বুঝতে পারছেন?
কিভাবে হাইকোর্টের দিকে নজর রেখেছিলো, কিভাবে এই বিষয়টিকে একটি ক্ষোভের কন্টেন্ট হতে পারে, তা ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলো। এগুলো সব কিছুকেই অল্প অল্প করে জোড়া দিন। বুঝতে পারবেন।
রাষ্ট্র নিশ্চই এই রিট দায়ের, রিটের পরে রায়, হাইকোর্ট সমস্ত কিছুই ক্রনোলজিকালী মিলিয়ে ও খতিয়ে দেখবেন এবং প্রতিটি যায়গায় তথ্য সংগ্রহ করবেন।
মার্কিনিদের ষড়যন্ত্রে এই প্রজন্মের সন্তানেরা পা দিয়েছেন। এটা তাদের বুঝবার কথা নয় ফলে এই নিয়ে তাদেরকে দোষারোপও আমি করিনা। এই গভীরভাবে ভাবার বয়স তাদের হয়নি।
আমাদের তরুনেরা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি, মুক্তিযুদ্ধের পরের সময় দেখেনি। মার্কিন-পাকিস্তান ষড়যন্ত্রে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ড এবং তার পরবর্তী ঘটনাও খুব জানে বলে আমার অন্তত মনে হয়না।
একটা সময় মানুষ বুঝতে পেরেছিলো যে, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ড কি কি হিসেব নিকেশের মধ্যে হয়েছিলো এবং মার্কিন-পাকিস্তানি সংস্থাগুলো আসলে কি চেয়েছিলো। কিন্তু ততদিনে যা ক্ষতি হবার এই দেশের হয়ে গিয়েছিলো।
এবারো তারা এখন যা বুঝতে পারছেনা, বুঝবে কুড়ি বছর পরে। তখন মাথা চাপড়াবে আর কাঁদবে কিন্তু কিছু করার থাকবে না।
তারা বিলাপ করবে, আক্রান্তবোধ করবে এবং বলতে থাকবে, ‘আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেছে’; কিন্তু কেউ তাদের বাঁচাতে আসবে না।
প্রজন্ম আমাকে জিজ্ঞেস করতে পারে, ‘কই আমরা তো মিছিলে গিয়েছি, সভাতে গিয়েছি হাইকোর্টের রায় জানতে পাবার পর। এখানে আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা আসবে কিভাবে?’
এই যায়গাতেই তো অংক। ভাবতে হবে এখানেই।
কোটা নিয়ে কেন রিট করা হয়েছে? হাইকোর্টের রায় কেন এমন হলো? কারা রাস্তায় নেমেছিলো আগে? কেন নেমেছিলো আপীলেট ডিভিশানের রায়ের আগে?
কারা পানি দিলো? কারা নেট দিলো? কারা এত সাহায্য করলো নেপথ্যে? কারা কাছে এসে উষ্কে দিলো? সমন্বয়কদের গত ৫ বছরের হিসেব নিকেশ কি? কারা এরা?
কোন পত্রিকা এত কাভারেজ দিলো শুরুতে? কেন দিলো? কারা ফোন করে বার বার খোঁজ নিয়েছে? কারা সব ধরনের সাহায্য দেয়ার জন্য উন্মুখ হয়েছিলো? কেন ছিলো? কারা এখন গণতদন্ত কমিশন গঠন করেছিলো?
শেখ হাসিনাকে প্রজন্ম ভুলভাবে অনুবাদ করলে সেটার একটা দীর্ঘ মেয়াদী দায় এই অস্থির জেনারেশনকেই চুকোতে হবে পরবর্তীতে। কষ্টের বিষয় হচ্ছে, ওরা তা এখন বুঝতে পারছে না।
আমাদের কৈশোরে আমাদের বাবা ছিলো আমাদের অন্যতম প্রধান শত্রু। বন্ধুদের সাথে মিশতে দেয়না, কনসার্টে যেতে দেয়না, বন্ধুদের সাথে ট্যুরে যেতে দেয়না, একা ঘর থেকে বের হতে দেয়না। কত অভিযোগ…
আজ সব বুঝি। সব অনুধাবন করি। কিন্তু আব্বার হাত ধরে দেখি তাঁর বয়স ৮৩ হয়ে গেছে। সময় গিয়েছে চলে স্রোতের মতন…আর ফেরার সময় নেই।
আমার এই লেখাটা সংরক্ষন করে রাখুন। কাজে লাগবে। আমি এই প্রজন্মের সাথে এই মুহুর্তে দ্বিমত পোষন করছি বলে তাদের অনেকেই আমার বিরুদ্ধে। কিন্তু তারা জেনে রাখুক, আমি স্পস্টবাদী একজন মানুষ।
আমাকে এখন খুবই খারাপ লাগবে। কিন্তু এক সময় আমাকে এরা খুঁজে বের করে পড়বে ঠিকই। আমার কাছে এসে তাঁরা অনুতপ্ত হবে।
আমি আর যাই করি,এই প্রজন্মকে অন্তত মিসগাইড করবোনা।
Leave a Reply