নিউজ ডেস্ক ঢাকা: গত ৫ আগস্ট গণঅভ্যূত্থানে দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেন সদ্য-সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে ঠিক কোন ‘ইমিগ্রেশন স্ট্যাটাসে’ শেখ হাসিনা এই মুহূর্তে ভারতে রয়েছেন, স্পষ্ট করে জানাননি নরেন্দ্র মোদি সরকার। তবে ভারতে অনেক পর্যবেক্ষকই বলছেন, পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে ভারতকে হয়তো শেষ পর্যন্ত দীর্ঘকালীন ভিত্তিতে ‘রাজনৈতিক আশ্রয়’ দেয়ার জন্যই প্রস্তুত থাকতে হবে। আর সেটাও হতে পারে বেশ লম্বা সময়ের জন্য। খবর বিবিসি’র।
শেখ হাসিনা ছাড়াও আরো অনেক রাজনৈতিক নেতাই তাদের দেশের বিরূপ পরিস্থিতিতে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য, দালাই লামা, নেপালের রাজা ত্রিভুবন, মালদ্বীপের সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহামেদ নাশিদ, আফগানিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট নাজিবুল্লাহর পরিবার ছাড়া ও আরও অনেক নেতাই রয়েছেন। এছাড়া বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, কামরুজ্জামান, সৈয়দ নজরুল ইসলামসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ ও মাঝারি স্তরের প্রায় সকল নেতাই ভারতে আশ্রয় নেন। এছাড়াও ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার পরও শেখ হাসিনা তার পরিবার ও অনেক আওয়ামী লীগ নেতা ভারতে আশ্রয় নেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা কাদের সিদ্দীকি।
গত ৬ আগস্ট ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর দেশটির পার্লামেন্টে জানিয়েছিলেন, শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে তার আগের দিন (৫ অগাস্ট) ‘সাময়িকভাবে’ বা তখনকার মতো ভারতে আসার অনুমোদন চাওয়া হয়, যেটা মঞ্জুর করা হয়েছিল। এখন পর্যন্ত ওটাই শেখ হাসিনার এ দেশে থাকার ব্যাপারে ভারত সরকারের শেষ ঘোষিত অবস্থান। শেখ হাসিনার দিল্লিতে থাকার মেয়াদ কত দীর্ঘায়িত হতে পারে, এ বিষয়ে সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তারা নিজেরাও অন্ধকারে, স্বভাবতই তারা এটা নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাইছেন না।
শেখ হাসিনা (১৯৭৫)
শেখ হাসিনা নিজেও ১৯৭৫-এ তার বাবা শেখ মুজিবর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর ব্যক্তিগত জীবনে যখন ভয়াবহ সঙ্কটে, তখন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছ থেকে রাজনৈতিক আশ্রয় পেয়েছিলেন। সেই যাত্রায় স্বামী ও সন্তানদের নিয়ে প্রায় দীর্ঘ ছয় বছর ভারতে কাটিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। যদিও নিরাপত্তার স্বার্থে দিল্লির পান্ডারা পার্কে তাদের সেই বসবাসের ব্যবস্থা করা হয়েছিল ভিন্ন নাম ও পরিচয়ে।
প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশে বাঙালি কংগ্রেস নেতা প্রণব মুখার্জি তখন শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের স্থানীয় অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করতেন, সেই সুবাদে তাদের মধ্যে গড়ে উঠেছিল নিবিড় ব্যক্তিগত হৃদ্যতাও। যে কারণে আজীবন প্রণব মুখার্জিকে ‘কাকাবাবু’ বলেই সম্বোধন করে এসেছেন শেখ হাসিনা।
প্রবাসী সরকার (১৯৭১)
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তাজউদ্দিন আহমেদ-সহ আওয়ামী লীগের একাধিক শীর্ষস্থানীয় নেতা ভারতে পালিয়ে চলে গেলে তাদেরও আশ্রয় দেয়া হয়েছিল।
দালাই লামা (১৯৫৯) ঐতিহাসিক রামচন্দ্র গুহ তার আকরগ্রন্থ ‘ইন্ডিয়া আফটার গান্ধী’তে লিখেছেন, ‘১৯৫৯ সালের মার্চ মাসের শেষ দিনটিতে দালাই লামা ম্যাকমোহন লাইন অতিক্রম করে ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের ভূখণ্ডের প্রবেশ করেন। তার আগে বেশ কয়েক বছর ধরে তিব্বতের এই ‘ঈশ্বর-রাজা’ লাসা-য় তার পোটালা প্যালেসের সিংহাসনে দিন কাটাচ্ছিলেন চরম অস্বস্তির মধ্যে, কারণ তিব্বতের ওপর চীনের কব্জা ক্রমশ এঁটে বসছিল। একটি সূত্র জানাচ্ছে, তখনই অন্তত পাঁচ লাখ চীনা সৈন্য তিব্বতে মোতায়েন ছিল, পাশাপাশি আরো ছিল তার অন্তত ১০ গুণ হুন বসতি স্থাপনকারী।’
১০ মার্চ ১৯৫৯ তিব্বতে মোতায়েন চীনের একজন জেনারেল একটি নাচের অনুষ্ঠানে দালাই লামাকে আসার আমন্ত্রণ জানান, কিন্তু এটাও বলে দেয়া হয় যে তার দেহরক্ষীরা সেখানে ঢুকতে পারবে না। অনুষ্ঠানের দিন হাজার হাজার তিব্বতি দালাই লামার প্রাসাদের সামনে জড়ো হয়ে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে থাকেন। তিব্বতিরা বহুদিন ধরেই সন্দেহ করছিলেন যে তাদের ধর্মগুরুকে চীনারা অপহরণ করার ষড়যন্ত্র আঁটছে, এই ঘটনায় তাদের সেই ধারণা আরো বদ্ধমূল হয়।
এর ঠিক আগের বছরই (১৯৫৮) পূর্ব তিব্বতের খাম্পা জনজাতি এই চীনা ‘দখলদার’দের বিরুদ্ধে সশস্ত্র অভ্যুত্থান করেছিল। খাম্পারা শুরুতে কিছুটা সাফল্য পেলেও চীনা বাহিনী খুব শক্ত হাতে সেই বিদ্রোহ দমন করে এবং এরপর দালাই লামাকে পর্যন্ত নিশানা করার ইঙ্গিত দিতে থাকে।
ইতোমধ্যে লাসায় নিযুক্ত ভারতীয় কনসালের সাথে যোগাযোগ করেছিলেন তিব্বতি নেতৃত্ব। ২৩ বছর বয়সী দালাই লামাকে ভারত রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে প্রস্তুত, এই আশ্বাস মেলার পর গোপনে রাতের অন্ধকারে কয়েকজন বাছাই-করা বিশ্বস্ত সঙ্গীকে নিয়ে তিনি ছদ্মবেশে লাসা ত্যাগ করেন।
রামচন্দ্র গুহ আলো লেখেন, ভারতের মাটিতে দালাই লামা তার প্রথম রাতটি কাটান তাওয়াং-এর একটি বৌদ্ধ মনাস্টারিতে। তারপর তিনি ক্রমশ পাহাড় থেকে নেমে আসেন সমতলে, পৌঁছান আসামের শহর তেজপুরে। সেখানে ভারতের কর্মকর্তারা লম্বা সময় ধরে তাকে ‘ডিব্রিফ’ করেন। ঠিক তিন সপ্তাহ পর প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করিয়ে দেয়ার জন্য তাকে নিয়ে যাওয়া হয় দিল্লিতে।
৩ এপ্রিলই প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু পার্লামেন্টে ঘোষণা করেছিলেন, তিব্বতি ধর্মগুরু দালাই লামা- যাকে তার অনুগামীরা ভগবান বুদ্ধের জীবন্ত অবতার বলে মনে করেন, তিনি ভারতে চলে এসেছেন এবং ভারত সরকার তাকে ‘রাজনৈতিক আশ্রয়’ দিয়েছে।
মোহাম্মদ নাজিবুল্লাহ্ (১৯৯২)
মোহাম্মদ নাজিবুল্লাহ্ আহমদজাই, যিনি শুধু ‘নাজিবুল্লাহ’ নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন, তিনি ১৯৮৬ সালে সোভিয়েতের সমর্থনে আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট পদে আসীন হন। প্রায় ছয় বছর প্রেসিডেন্ট পদে থাকার পর ইসলামি মুজাহিদিনরা যখন ১৯৯২ সালের এপ্রিলে কাবুল দখল করে, তখন প্রেসিডেন্ট পদে ইস্তফা দিয়ে নাজিবুল্লাহ্ ভারতের কাছে আশ্রয় চান, তা মঞ্জুরও হয় সাথে সাথেই।
১৯৯২ সালে ভারতে যাওয়ার চেষ্টায় এয়ারপোর্টে পৌঁছানোর পথেই আফগান নিরাপত্তারক্ষীরা নাজিবুল্লাহকে আটকে দেন, তার আর দিল্লির বিমানে ওঠা সম্ভব হয়নি।
নিজের জীবন বাঁচাতে নাজিবুল্লাহ এরপর গিয়ে আশ্রয় নেন কাবুলে জাতিসঙ্ঘের কার্যালয়ে, যেখানে মুজাহদিনরা চট করে ঢুকতে পারবে না বলে তিনি ধারণা করেছিলেন।
এসে নামে, যাতে করে ত্রিভুবন শাহ ও পরিবারের অন্যরা (শিশু রাজা জ্ঞানেন্দ্রকে ফেলেই) দিল্লিতে রওনা হয়ে যান। ঘটনাচক্রে ওই এয়ারপোর্টের এখন নামকরণ করা হয়েছে রাজা ত্রিভুবন শাহ-এর নামেই।
দিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ও অন্য সরকারি কর্মকর্তারা তাদের স্বাগত জানান। রাজা ত্রিভুবন শাহ ও পরিবারের বাকি সবাইকে ভারত রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়।
তবে রাজা ত্রিভুবন শাহকে মাস তিনেকের বেশি ভারতে থাকতে হয়নি। রাজার দেশত্যাগে নেপাল জুড়ে রানাদের বিরুদ্ধে যে তীব্র বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল, তাতে সরকার ত্রিভুবন শাহর সাথে সমঝোতা করতে বাধ্য হয়, যে আলোচনায় ভারতও মধ্যস্থতা করেছিল।
১৯৫১ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি নেপালের ‘মনার্ক’ বা মহারাজা হিসেবে ত্রিভুবন বীর বিক্রম শাহ দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। ঘটনাচক্রে সেই ঘটনার প্রায় ৫৭ বছর পর নেপাল থেকে যখন রাজতন্ত্রের বিলোপ ঘটছে, সে সময়কার ‘শিশু রাজা’ জ্ঞানেন্দ্র শাহ তখন দেশের সিংহাসনে!
রাজার ওপর তখন দেশ ছাড়ার জন্য প্রচণ্ড চাপ, নির্বাচনে জয়ী হয়ে মাওবাদীরাও জ্ঞানেন্দ্রকে প্রাসাদ ছাড়ার জন্য চাপ দিচ্ছিলেন।
সম্প্রতি বিবিসি নেপালি বিভাগের একটি প্রতিবেদনে সে সময়কার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কমল থাপা জানিয়েছেন, রাজা জ্ঞানেন্দ্রকে আশ্রয় দিতে চেয়ে বাইরের অনেকগুলো দেশই তখন প্রস্তাব দিয়েছিল।
কমল থাপা বলেন, আমি একাধিক দেশের কথাই তখন শুনেছিলাম, তবে ভারতও যে সেই তালিকায় ছিল সে কথা আমি নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি।
এদিকে ভারত নেপালের রাজা জ্ঞানেন্দ্র শাহকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিচ্ছে কিনা, ভারতের তদানীন্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রণব মুখার্জিকেও বারবার সে প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছিল। প্রণব মুখার্জি অবশ্য প্রতিবারই সে প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়েছিলেন। তবে ভারত এই ধরনের প্রস্তাব দেয়নি, এ কথাও তিনি কখনো বলেননি।
ফলে ভারত রাজা জ্ঞানেন্দ্র শাহকে আশ্রয় দেয়ার প্রস্তাব দিয়ে রেখেছিল এটা মনে করার যথেষ্ঠ কারণ আছে, যদিও তিনি তা শেষ পর্যন্ত গ্রহণ করেননি।
সূত্র : বিবিসি
Leave a Reply