নিউজ ডেস্ক, ঢাকা: বাংলাদেশের চট্টগ্রাম নগরীর টেরিবাজার এলাকায় হিন্দু অধ্যুষিত হাজারী গলিতে ‘ইসকন নিয়ে ফেসবুকে দেয়া পোস্টকে’ কেন্দ্র করে সংঘটিত ঘটনায় অন্তত ৮২ জনকে আটকের জানিয়েছে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ বা সিএমপি। এছাড়া এ ঘটনায় মামলা হচ্ছে জানিয়েছে পুলিশ।
অন্যদিকে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বাধীন যৌথ বাহিনী চট্টগ্রামে এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছে, ওই এলাকায় যৌথবাহিনীর অভিযান অব্যাহত রয়েছে এবং হাজারী গলিসহ নগরীর অন্য এলাকাতেও নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে।
রাতে ওই এলাকায় যৌথ বাহিনীর অভিযানের সময় ব্যাপক লাঠিচার্জ ও মারধরের ছবি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে অভিযানের সময় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের ওপর নিপীড়নের অভিযোগ উঠেছে।
যৌথ বাহিনীর মুখপাত্র লে. কর্নেল ফেরদৌস আহমেদ সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, যৌথবাহিনীর ওপর সেখানে জুয়েলারির কাজে ব্যবহৃত এসিড হামলা ও ইট পাটকেলসহ কাঁচের বোতল ছোঁড়া হয়েছে। এতে পাঁচ সেনা সদস্য ও সাত জন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছে বলে জানান তিনি।
তিনি জানান যে ঘটনার সাথে জড়িতদের চিহ্নিতকরণের কাজ চলছে। অন্যদিকে পুলিশ বলছে তারাও তদন্ত শুরু করেছে।
প্রসঙ্গত, সাম্প্রতিক সময়ে চট্টগ্রামসহ কয়েকটি এলাকায় হিন্দু সংগঠন ইসকন বিরোধী বক্তৃতা বিবৃতি আসার পর ইসকনের দিক থেকে এর তীব্র সমালোচনা করা হয়েছে।
সম্প্রতি ইসকন তাদের নিয়ে ‘অসত্য’ বক্তব্য দেয়ার অভিযোগ করে আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের তীব্র সমালোচনা করেছে।
মি. রহমান এক অনুষ্ঠানে ‘ইসকনকে সাম্প্রদায়িক ও ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা র-এর’ সংগঠন হিসেবে মন্তব্য করেছিলেন।
ইসকন এক বিবৃতিতে বলেছে এটি একটি অরাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ ধর্মীয় সংগঠন।
কী ঘটেছিলো হাজারি গলিতে
স্থানীয়রা বলছেন, হাজারী গলির মিয়া শপিং সেন্টারে প্রায় দেড়শর মতো হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ জুয়েলারি ব্যবসা করে। সেখানেই জুয়েলারি বাক্স, মালা, মালায় ব্যবহৃত স্টোন এবং রূপার ব্যবসা করে এক মুসলিম ব্যবসায়ী।
তিনি হিন্দু সম্প্রদায়ের ইসকনকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ উল্লেখ করে ফেসবুকে একটি পোস্ট দেয়ার পর মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ওই এলাকার হিন্দুদের মধ্যে ক্ষোভ ও উত্তেজনা তৈরি হয়।
পরে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে কয়েক ঘণ্টা ধরে উত্তেজনা চলে ও একপর্যায়ে সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়। পরে ফেসবুকে পোস্ট দেয়া ব্যক্তিকে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ সেখানেই দোকানের ভেতরে ঘিরে ফেলে। এ সময় সেই দোকানে হামলার ঘটনা ঘটে।
বিক্ষুব্ধ লোকজন দোকানের সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকে। স্থানীয়রা বিক্ষোভকারীদের শান্ত করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলে পুলিশ ও সেনাবাহিনীকে খবর দেয়া হয়।
যৌথবাহিনী ঘটনাস্থলে গিয়ে ফেসবুকে পোস্টদাতা ব্যক্তিকে দোকান থেকে উদ্ধারের সময় বিক্ষোভকারীরা বাধা দেয়। তারা যৌথবাহিনীকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। পরে যৌথবাহিনী ওই ব্যক্তিকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায়।
এ সময় পুলিশ ও সেনাসদস্যদের লক্ষ্য করে জুয়েলারির কাজে ব্যবহৃত এসিড ব্যবহার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে যৌথ বাহিনী। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তখন যৌথবাহিনীকে কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছুঁড়তে হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
চট্টগ্রাম জুয়েলারি এসোসিয়েশনের যুগ্ম সম্পাদক কাজল বণিক বিবিসি বাংলাকে বলেছেন মঙ্গলবার রাত সাড়ে আটটা নাগাদ যৌথ বাহিনী হাজারী গলিতে ঢুকে যাকে পেয়েছে তাকেই মেরেছে। বাসা-বাড়িতে হামলা করা হয়েছে। পরে সব দোকান বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
“এলাকার সব ব্যবসায়ী হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ। সেখানেই কাজ করা একজন যদি ধর্মীয় সংগঠনকে আক্রমণ করে তাহলে হিন্দুদের মধ্যে ক্ষোভ হবে না? ক্ষোভ থেকে প্রতিবাদ হয়েছে। সেখানে নির্বিচারে হামলা করা হয়েছে মানুষের ওপর,” বলছিলেন তিনি।
তবে যৌথবাহিনীর সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়েছে, সোমবার বিকেলে ওসমান আলী নামে একজন ব্যক্তির ইসকন বিরোধী একটি ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে হাজারী লেইনে উত্তেজনার সৃষ্টি হয় এবং ৫/৬শ দুষ্কৃতিকারী সেখানে ওসমান আলী ও তার ভাইকে হত্যা ও দোকান জ্বালিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে জড়ো হয়।
“মব জাস্টিস রোধে যৌথবাহিনী ওসমান আলী ও তার ভাইকে ওই এলাকা থেকে উদ্ধার করে। উত্তেজিত জনতাকে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সমাধানে আশ্বস্ত করার পরেও এক পর্যায়ে উগ্র বিশৃঙ্খলকারীরা আরও আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। দুর্বৃত্তরা এ সময় যৌথবাহিনীর ওপর অতর্কিতভাবে জুয়েলারির কাজে ব্যবহৃত এসিড হামলা চালায় এবং ভারী ইট পাটকেলসহ ভাঙ্গা কাঁচের বোতল ছুঁড়তে শুরু করে,” ব্রিফিংয়ে বলা হয়।
চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের মুখপাত্র কাজী মো. তারেক আজিজ বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, এই ঘটনায় অন্তত ৮২ জনকে আটক করা হয়েছে এবং একটি মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া চলছে।
এছাড়া ‘ফুটেজ ও গোয়েন্দা তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে প্রকৃত দুষ্কৃতিকারীদের চিহ্নিত করার কাজ’ চলছে বলে তিনি জানান।
আলোচনায় ইসকন
ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর কৃষ্ণ কনশাসনেস (ইসকন) বা আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ হলো বৈষ্ণব মতবাদের একটি হিন্দু ধর্মীয় সংগঠন, যারা তাদের আধ্যাত্মিক দর্শন প্রচার করে থাকেন বলে তাদের ওয়েবসাইটে উল্লেখ রয়েছে। বিশ্বের অনেক দেশে এই সংগঠনের শাখা রয়েছে।
সাম্প্রতিক কালে ইসকনের বিরুদ্ধে বেশ কিছু বক্তব্য আসছিলো।
স্থানীয় পর্যায়ে কেউ কেউ সামাজিক মাধ্যমেও ইসকনকে আক্রমণ করে পোস্ট করছিলেন। হাজারী গলির ব্যবসায়ী ওসমান আলীর পোস্টও তেমনই একটি পোস্ট বলে মনে করছেন হাজারি গলির ব্যবসায়ীরা।
“মুসলিমদের ধর্মীয় সংগঠন নিয়ে অন্যরা বিরূপ মন্তব্য করলে তাদের যেমন খারাপ লাগা স্বাভাবিক, তেমনি আমাদের ধর্ম বা ধর্মীয় সংগঠনকে অবমাননা করলে কী আমাদের ক্ষোভ হবে না?” বলছিলেন ওই মার্কেটেরই একজন ব্যবসায়ী। তিনি তার নাম না প্রকাশ করার অনুরোধ করেছেন।
প্রসঙ্গত, সম্প্রতি ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে ইসকন বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক শ্রী চারু চন্দ্র দাস ব্রহ্মচারী এক সংবাদ সম্মেলনে ‘দৈনিক আমার দেশ’ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে ইসকন নিয়ে ‘ভিত্তিহীন ও অসত্য হুমকি’ দেয়ার অভিযোগ করেছেন।
চারু চন্দ্র দাস ব্রহ্মচারী তখন বলেছিলেন যে সম্প্রতি বিভিন্ন মহল প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ইসকন বাংলাদেশকে নিয়ে বিভ্রান্তিকর গুজব ছড়াচ্ছে।
গত মাসের শেষের দিকে আট দফা দাবিতে চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে বিশাল একটি সমাবেশ করেছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্যরা। সেখানে তারা সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা ও নিপীড়নের বিচার, জড়িতদের শাস্তি দেয়া, ক্ষতিপূরণ দেয়া, সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন করার মতো দাবি জানান।
সেই সমাবেশের পর মাহমুদুর রহমান এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, “ইসকনের মতো একটা সাম্প্রদায়িক ও র- এর একটি সংগঠন চট্টগ্রামে এতো বড় সভা করে। ইসকনের মধ্যে দেখবেন ছাত্রলীগ যুবলীগের গুণ্ডারা বসে আছে”।
তখন সরকার সমর্থকরা অভিযোগ করেছিল যে, ‘সরকারকে চাপে ফেলতে কিংবা আওয়ামী লীগকে সুযোগ করে দিতে মাঠে নেমেছেন’ তারা মাঠে নেমেছে।
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে চারু চন্দ্র দাস ব্রহ্মচারী বলছেন, “ইসকন একটি অরাজনৈতিক ধর্মীয় আন্তর্জাতিক সংগঠন। ইসকন বাংলাদেশ বরাবরই সকলের প্রতি মানবিক সহমর্মিতা ও ধর্মীয় সহনশীলতার বার্তা প্রচার করেছে এবং জাতীয় সম্প্রীতি ও ঐক্যের পক্ষে কাজ করেছে।”
”সুতরাং এসব মিথ্যা প্রচারণা শুধু বাংলাদেশ ইসকনের ভাবমূর্তিকেই ক্ষতিগ্রস্ত করেনি, বরং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও ইসকনের পাশাপাশি বাংলাদেশের সুনাম নষ্ট করছে এবং আমরা এ ধরনের বিভ্রান্তিকর প্রচারণার তীব্র নিন্দা জানাই,” বলেছেন তিনি।
এদিকে সনাতন জাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র কাঞ্চন আচার্য বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, হাজারী গলিতে ইসকনের নামে মিথ্যা অপবাদ দেয়ার পর আবার হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের ওপরেই হামলা হলো।
ইসকন বাংলাদেশে সাধারণ সম্পাদক চারু চন্দ্র দাস ব্রহ্মচারী এক বিবৃতিতে বলেছেন, চট্টগ্রামের ঘটনাতেও ইসকনকে জড়িয়ে ধর্মীয় ও সামাজিক ভাবমূর্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করার চেষ্টা করছে। এ ধরনের অবাঞ্ছিত ঘটনা রোধে আগেই সরকার ও প্রশাসনকে তিনি অনুরোধ করেছেন।
Leave a Reply