নিউজ ডেস্ক, ঢাকা: ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল এ দেশের একজন জনপ্রিয় লেখক, পদার্থবিদ ও শিক্ষাবিদ। তিনি বাংলাদেশের আলোচিত-সমালোচিত একজন বুদ্ধিজীবি এবং সম্ভবত দক্ষিণ এশিয়ার এযাবৎকালের শ্রেষ্ঠ সায়েন্স ফিকশন লেখক। তরুন প্রজন্মের অনেকেরই আদর্শ তিনি।
এছাড়াও তিনি একজন জনপ্রিয় শিশুসাহিত্যিক এবং কলাম-লেখক। তার লেখা বেশ কয়েকটি উপন্যাস চলচ্চিত্রে রূপায়িত হয়েছে। তার সায়েন্স ফিকশন তরুণ তরুণীদের ভীষণ প্রিয় গ্রন্থ।
জাফর ইকবালের জন্ম ২৩শে ডিসেম্বর ১৯৫২, সিলেট। তাঁর পিতা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ফয়জুর রহমান আহমদ এবং মা আয়েশা আখতার খাতুন। পিতার পুলিশের চাকরির সুবাদে তার ছোটবেলা কেটেছে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায়। মুহম্মদ জাফর ইকবালের নাম আগে ছিল বাবুল।
ডঃ জাফর ইকবালের পিতা লেখালেখির চর্চা করতেন এবং পরিবারের এই সাহিত্যমনস্ক আবহাওয়ায় জাফর ইকবাল খুব অল্প বয়স থেকেই লিখতে শুরু করেন।
এটিকেই তিনি তার সহজ ভাষায় লিখতে পারার গুণের কারণ বলে মনে করেন। তিনি তার প্রথম বিজ্ঞান কল্পকাহিনী লেখেন সাত বছর বয়সে।
ডঃ জাফর ইকবাল এর মা আয়েশা ফয়েজ ছিলেন গৃহিনী । পাশাপাশি তিনি নিজেও লেখিকা ছিলেন। সন্তানদের লিখা পড়তে খুব পছন্দ করতেন। স্বামীর মৃত্যুর পড়ে তিনিই ছয়টি ছেলেমেয়েকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে বিয়ে দিয়ে ছিলেন।
জাফর ইকবাল বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তারই সহপাঠী ইয়াসমিন হকের সাথে। ইয়েশিম ও নাবিল তাদের দুই সন্তান।
জাফর ইকবাল ১৯৬৮ সালে বগুড়া জিলা স্কুল থেকে এসএসসি এবং ১৯৭০ সালে ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন। তিনি ১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন।
ড. জাফর ইকবাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন যথাক্রমে ১৯৭৫ ও ১৯৭৬ সালে। তিনি ১৯৮২ তে ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচ.ডি সম্পন্ন করেন।
জাফর ইকবাল ১৯৮২ থেকে ১৯৮৮ পর্যন্ত ক্যালিফোর্নিয়া ইনিস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে সাফল্যের সাথে ডক্টরেটোত্তর গবেষণা সম্পন্ন করেন।
১৯৮৮ তে তিনি বিখ্যাত বেল কমিউনিকেশনস রিসার্চ (বেলকোর) এ গবেষক হিসাবে যোগদান করেন এবং ১৯৯৪ পর্যন্ত সেখানেই কাজ করেন। ওই বছরেই তিনি দেশে ফিরে আসেন।
দেশে এসে জাফর ইকবাল সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে যোগদান করেন।
তিনি একাধিকবার বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য মনোনীত হন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তিনি এক সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সংগঠন শিক্ষক সমিতির সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন।
অবসর গ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক এবং তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক্স প্রকৌশল বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কর্মরত ছিলেন ।
জাফর ইকবাল বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকেই লেখালেখি করেন। তার প্রথম বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীমূলক গল্প কপোট্রনিক ভালোবাসা সাপ্তাহিক বিচিত্রায় প্রকাশিত হয়েছিল। গল্পটি পড়ে একজন পাঠক দাবি করেন সেটি বিদেশি গল্প থেকে চুরি করা।
এর উত্তর হিসেবে তিনি একই ধরণের বেশ কয়েকটি
বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীমূলক গল্প বিচিত্রার পরপর কয়েকটি সংখ্যায় লিখে পাঠান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকালে এই গল্পগুলো নিয়ে কপোট্রনিক সুখ-দুঃখ নামে একটি বইও প্রকাশিত হয়।
এই বইটি পড়ে শহীদ-জননী জাহানারা ইমাম খুবই প্রশংসা করেন এবং এই ঘটনায় তিনি এ ধরণের আরও বই লিখতে উৎসাহিত হন। তার প্রথম দিকের বিজ্ঞান কল্পকাহিনীগুলো পাঠকমহলে প্রচুর সমাদৃত হয়।
সুদূর আমেরিকাতে বসে তিনি বেশ কয়েকটি বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী রচনা করেন। দেশে ফিরে এসেও তিনি নিয়মিত বিজ্ঞান-কল্পকাহিনী লিখে যাচ্ছেন, প্রতি বইমেলাতে তার নতুন সায়েন্স ফিকশান কেনার জন্যে এখনো পাঠকেরা ভীড় জমায়।
ডঃ জাফর ইকবাল কিশোর উপন্যাসের লেখক হিসেবেও অত্যন্ত সফল। এই শাখাতেই তার প্রতিভা সর্বোচ্চ শিখর ছুঁয়েছে। তার লেখা অনেকগুলো কিশোর উপন্যাস বাংলা কিশোর-সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে।
তার একাধিক কিশোর উপন্যাস থেকে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে।তার বৈশিষ্ট্যসূচক সহজ ভাষায় লেখা কলামগুলো অত্যন্ত জনপ্রিয়। তিনি দৈনিক প্রথম আলো, দৈনিক কালের কন্ঠ সহ একাধিক পত্রিকায়সাদাসিধে কথা নামে নিয়মিত কলাম লিখে থাকেন।
ডঃ জাফর ইকবাল এর লেখা কলামগুলোতে তাঁর রাজনৈতিক সচেতনা এবং দেশপ্রেমের পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁর স্বাধীনতা-বিরোধী ও ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে সরাসরি মত প্রকাশ এবং প্রগতিশীল চিন্তাধারার ধারক হিসেবে সমাদৃত হয়েছে।
বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড গড়ে তোলার পিছনে ডঃ জাফর ইকবাল এর অসামান্য অবদান রয়েছে। গণিত শিক্ষার উপর তিনি ও অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ বেশ কয়েকটি বই রচনা করেছেন।
এর মাঝে “নিউরনে অনুরণন” ও “নিউরনে আবারো অনুরণন” বই দুটি গণিতে আগ্রহীদের কাছে খুব জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।
উল্ল্যখযোগ্য রচনা–বিবর্ণ তুষার, দুঃস্বপ্নের দ্বিতীয় প্রহর, কাচসমুদ্র, সবুজ ভেলভেট ক্যাম্প, মহব্বত আলীর একদিন।।ছোট গল্প–একজন দুর্বল মানুষ, ক্যাম্প, ছেলেমানুষী ইত্যাদি।
বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী– কপোট্রনিক সুখ দুঃখ, মহাকাশে মহাত্রাস, ক্রুগো, ত্রিনিটি রাশিমালা, রবো নগরী, একজন অতিমানবী,জলজ,ফিনিক্স, রুহান রুহান, জলমানব, অক্টোপাসের চোখ,ব্ল্যাক হোলের বাচ্চা, সেরিনা, ক্রেনিয়াল, রিটিন, ত্রাতিনা ইত্যাদি।
কিশোর উপন্যাস– দীপু নাম্বার টু, দুষ্টু ছেলের দল,আমার বন্ধু রাশেদ,মেকু কাহিনী, শান্তা পরিবার, কাজলের দিনরাত্রি, আমি তপু, লিটু বৃত্তান্ত, নাট বল্টু
ইস্টিশন, গাব্বু,টুনটুনি ও ছোটচাচ্চু, গ্রামের নাম কাঁকনডুবি, তবুও টুনটুনি তবুও ছোটাচ্চু, সাইক্লোন ইত্যাদি।
শিশুতোষ– হাকাহাকি ডাকাডাকি, ভূতের বাচ্চা কটকটি, ইঁদুর এবং দুষ্ট হাতি৷ বিজ্ঞান ও গণিত বিষয়ক
নিউরণে অনুরণন, একটু খানি বিজ্ঞান, গণিতের মজা মজার গণিত, থিওরি অফ রিলেটিভিটি, কোয়ান্টাম মেকানিক্স, সহজ ক্যালকুলাস ইত্যাদি।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস– ছোটদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস।
ডঃ জাফর ইকবাল অনেক পুরস্কার ও সম্মননা পেয়েছেন এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, ২০০৪ সালে সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় অবদানের জন্য ছয় জনকে পুরস্কিত করে বাংলা একাডেমি।
এর মধ্যে মোহাম্মদ জাফর ইকবাল সায়েন্স ফিকশনের জন্য পুরস্কিত হন। তাছাড়াও তিনি বিভিন্ন পুরস্কার অর্জন করেন। শ্রেষ্ঠ নাট্যকার হিসেবে ২০০৫ সালে মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার লাভ করেন।
২০০২ সালে কাজী মাহবুবুল্লা জেবুন্নেছা পদক, খালেদা চৌধুরি সাহিত্য পদক, ২০০৩ সালেশেলটেক সাহিত্য পদক, ২০০৪ সালে ইউরো শিশুসাহিত্য পদকলাভ করেন। এছাড়াও ২০০৫ সালে তিনি মোহা. মুদাব্বর-হুসনে আরা সাহিত্য পদক লাভ করেন ।
এছাড়া, ডঃ জাফর ইকবাল মার্কেন্টাইল ব্যাংক সম্মাননা পদক, আমেরিকা এল্যাইমনি এ্যসোসিয়েশন পদক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ্যালাইমনি এ্যাসোসিয়েশন পদক লাভ করেন।
২০১৮ সালের ৩রা মার্চ রোজ শনিবার বিকালে সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তমঞ্চে ইলেকট্রিকাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) উৎসবের রোবটিক প্রতিযোগিতার সমাপনী অনুষ্ঠানে জংগীরা ডঃ জাফর ইকবালকে এ আক্রমণ চালায়।
আজ জনপ্রিয় লেখক, পদার্থবিদ ও শিক্ষাবিদ এবং বাংলাদেশের আলোচিত একজন বুদ্ধিজীবি ডঃ জাফর ইকবাল এর জন্মদিন। আজকের এই দিনে উনাকে অনেক অনেক শুভেচ্ছা ও শুভ কামনা রইলো।
সৌজন্যে আলীম আল রশীদ
Leave a Reply