1. editor1@japanbanglapress.com : editor1 :
  2. japanbanglapress@japanbanglapress.com : japanbanglapress :
  3. mdzahidulislam1000@gmail.com : zahid :
সাম্প্রতিক :
আজ বিকালে মুদ্রানীতি ঘোষণা করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২৩ বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠালো মালয়েশিয়া মব জাস্টিসের নামে মগের মুল্লুক কায়েমের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলুন-সাইফুর রহমান কায়েস শেখ হাসিনার সরকার হটাতে মার্কিন নীলনকশার গোপন নথি ফাঁস শেখ হাসিনার সরকার হটাতে মার্কিন নীলনকশা ‘কোনো দলের পক্ষে বা বিপক্ষে থাকতে চাই না’ “মানুষ ও সময়: শক্তি, সংগ্রাম এবং সহজতার দ্বন্দ্ব”-মোহাম্মদ ওয়াহিদুজ্জামান বিশ্বাস। চার দফা দাবিতে শাহবাগে ম্যাটস শিক্ষার্থীদের অবস্থান বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের সূতিকাগার ধানমন্ডি-৩২ ধ্বংসের নিন্দা ও প্রতিবাদ এবং স্বাধীনতা বিরোধীদের মোকাবেলায় জাতীয় ঐক্যের আহবান স্টামফোর্ডের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ফারাহনাজ ফিরোজ

জাপানের জীবনদাতা বিচারপতি রাধাবিনোদ পাল প্রবীর বিকাশ সরকার

  • আপডেটের সময় : মঙ্গলবার, ২৮ জানুয়ারী, ২০২৫

নিউজ ডেস্ক, জাপান: এই জানুয়ারি মাসেই অকুতোভয় এক বাঙালির জন্ম ও মহাপ্রয়াণ। আজকে ২৭ জানুয়ারি তার ১৩৯তম জন্মবার্ষিকী। গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করি।  আমরা বাঙালিরা কি জানি এই মহান বাঙালি সন্তান সম্পর্কে কিছু?

জাতীয় ক্ষেত্রে সংরক্ষণ, প্রদর্শন ও প্রচার না থাকার কারণে বাঙালি জাতির বহু কীর্তি যেমন বিলুপ্ত হয়ে গেছে, তেমনি কীর্তিমান মানুষও মিলিয়ে গেছেন, না হয় বিলীয়মান। বিশ্বনন্দিত আন্তর্জাতিক আইনবিশেষজ্ঞ বিচারপতি ড.রাধাবিনোদ পালকে (২৭.১.১৮৮৬–১০.১.১৯৬৭) ভারত ভুলে গেছে, বাংলাদেশ তাঁকে জানে না কিন্তু সুপ্রতিষ্ঠিত তিনি জাপানে।
বিশ্বযুদ্ধ পূর্বকালে জাপানের সঙ্গে বাঙালির আধ্যাত্মিক সম্পর্কের সূচনা হয়েছিল উনিশ শতকের শেষ দিকে বা বিংশ শতকের শুরুতে। আর প্রস্ফুটিত হয়েছে জাপানে ড.রাধাবিনোদ পালের উত্থানের মধ্য দিয়ে। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের যে, সেই আলোকিত ইতিহাস বাঙালির সামনে তুলে ধরা হয়নি।
শুধু রাধাবিনোদ পালই নয়, মেইজি যুগে (১৮৬৮-১৯১২) পূর্ববঙ্গ থেকে একাধিক বাঙালি জাপানে এসে ব্যবসাসংক্রান্ত অভিজ্ঞতা অর্জন করে স্বদেশে গিয়ে কলকারখানা স্থাপন এবং জাপানভ্রমণ বিষয়ক গ্রন্থ লিখে রেখে গেছেন কবি রবীদ্রনাথ ঠাকুর জাপানে আসার অনেক আগে। যেমন মন্মথনাথ ঘোষ, সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, হরিপ্রভা (মল্লিক) তাকেদা প্রমুখ। মন্মথনাথ ১৯০৬ সালের দিকে জাপানে এসেছিলেন এবং প্রযুক্তি শিখে স্বদেশে গিয়ে কারখানা স্থাপন করেছিলেন বলে জানাচ্ছেন বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক সুব্রত কুমার দাস। মন্মথনাথ ঘোষের জন্ম যশোরে। সুরেশচন্দ্রও বাংলাদেশেরই, হরিপ্রভা ছিলেন ঢাকার ব্রাহ্মসমাজের মেয়ে, জাপানি সাবান কারিগর উয়েমোন তাকেদার সঙ্গে বিয়ে হয় ১৯০৭ সালে। অন্যদিকে বিপ্লবী রাসবিহারী বসু ১৯১৫ সালে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৬ সালে, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ১৯৪৩ সালে, রাধাবিনোদ পাল ১৯৪৬ সালে, ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাপানে অভূতপূর্ব আতিথেয়তা, সংবর্ধনা অর্জন করেছিলেন। আরও বেশ কিছু বিশিষ্ট জাপানি এবং বাঙালি আসা-যাওয়া করেছেন উভয় দেশেই। এই ধারা এখনো বিদ্যমান কিন্তু শক্তিশালী রূপ ধারণ করতে পারেনি। এই সম্ভাবনাময় সম্পর্কটার কোনো মূল্যায়ন করার চেষ্টাই করেনি উভয় অঞ্চলের বাঙালিরা আজও।
একথা অনিস্বীকার্য যে, সচরাচর অন্যান্য জাতির সঙ্গে জাপানের সম্পর্ক অতটা গভীর নয় একমাত্র কোরিয়া ও চীন ব্যতিরেকে। পূর্ব এশিয়া তথা দূরপ্রাচ্যের অঞ্চল হিসেবে এদের ঘনিষ্ঠতা স্বাভাবিকভাবেই থাকার কথা। কিন্তু জাপান থেকে বহুদূর দক্ষিণ এশিয়ার ভারতবর্ষ। তথাপি আধুনিক যুগের প্রারম্ভেই জাপান-ভারতবর্ষের মধ্যে শিক্ষা-সাংস্কৃতিক-ধর্মীয় ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বুদ্ধিবৃত্তিক আদান-প্রদান ঘটে। বিশেষ করে, রুশ-জাপান যুদ্ধ যাকে বলা হয়ে থাকে ‘শূন্য বিশ্বযুদ্ধ’ (Zero World War) তাতে শ্বেতাঙ্গ জাতির বিরুদ্ধে জাপানিদের বিজয় অর্জন ভারতবর্ষ তথা বাংলা অঞ্চলে এমন গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল যে, ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয় বিপ্লবীরা জাপানকে লক্ষ্য করেছিলেন তাঁদের একমাত্র সহযোগী দেশ হিসেবে। কেননা ভারতবর্ষ তখন শ্বেতাঙ্গ বৃটিশ কর্তৃক শাসিত, শোষিত। আর তাই শ্বেতাঙ্গদেরকে বিতাড়িত করতে জাপানের সাহায্যই প্রয়োজন ছিল। এই যুদ্ধ অনেক সচেতন, জাতীয়তাবোধে উদীপ্ত বাঙালি তরুণকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। তরুণ বয়সে রাধাবিনোদ পাল ছিলেন তেমনি একজন।
বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলার (ভূতপূর্ব নদিয়া) প্রত্যন্ত অঞ্চল তারাগুনিয়া ইউনিয়ন, দৌলতপুর থানার সালিমপুর গ্রামে বর্তমানে তাঁর বাস্তুভিটার নাম মিরপুর উপজেলার কাকিলাদহ। এক নিতান্ত দরিদ্র পরিবারে জন্ম রাধাবিনোদ ছেলেবেলা থেকেই প্রচুর পরিশ্রম ও মেধার বলে মানুষ হয়েছিলেন। ১৯০৭ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে গণিতে বিএ অনার্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পরের বছরই একই প্রতিষ্ঠান থেকে একই বিষয়ে এমএ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণী লাভ করেন। মেধাবী রাধাবিনোদ জীবনের প্রথম চাকরিতে নিযুক্ত হন ১৯১১ সালে ময়মনসিংহ জেলার বিখ্যাত আনন্দমোহন কলেজের গণিত শাস্ত্রের অধ্যাপক হিসেবে। এখানে থাকাকালীন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার অব ল’ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হওয়ার গৌরব অর্জন করেন ১৯২০ সালে। ১৯২১ সালে কলিকাতা উচ্চআদালতে আইনজীবী হিসেবে যোগ দেন। ১৯২৪ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলডি অর্থাৎ ডক্টর অব ল’ ডিগ্রী লাভ করেন ‘মনুসংহিতাপূর্ব বৈদিক ও উত্তর বৈদিক যুগে হিন্দু আইন-দর্শন’ বিষয়ে সন্দর্ভ লিখে। একমাত্র তিনিই যিনি তিন-তিনবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্লভ ‘টেগোর ল’ প্রফেসর’ এর আসনে নির্বাচিত হন যথাক্রমে ১৯২৫-৩০-৪৮ সালে। তাঁর আগে যাঁরা এই আসনে উপবিষ্ট হয়েছিলেন তাঁরা ছিলেন, স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, স্যার গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, ড.বিজনকুমার মুখোপাধ্যায় এবং হার্ভাড ল’ স্কুলের অধ্যাপক রোসকো পাউন্ড (Roscoe Pound) ।
এই বিরল সম্মানের কারণে ভারত সরকার কর্তৃক ১৯২৭-৪১ সাল পর্যন্ত জাতীয় আয়কর দপ্তরের আইন উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছিলেন ড.পাল। ১৯৪১ সালে কলিকাতা উচ্চআদালতের বিচারপতি নির্বাচিত হন এবং ১৯৪৩ সালে অবসর নিয়ে পুনরায় ওকালতিতে ফিরে যান। কিন্তু পরের বছর আবার ডাক পড়ে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব গ্রহণের জন্য। দূরপ্রাচ্য টোকিও আন্তর্জাতিক মিলিটারি ট্রাইব্যুনালের ১১ জন বিচারপতির অন্যতম ভারতীয় বিচারপতি হিসেবে যোগদানের পূর্বে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত এই পদে আসীন ছিলেন। এই বিচারে তিনি যে সহ¯্র পৃষ্ঠারও অধিক রায় লিখেছিলেন তা আজ বিশ্বইতিহাস। আন্তর্জাতিক আইনের ক্ষেত্রে এক অপরিসীম অবদান। এই বুদ্ধিবৃত্তিক ও শ্রমলব্ধ রায়ের ভিত্তিতে কর্মবীর ড.পাল তাঁর প্রতিভা ও গুণগত কর্মকাণ্ডের মূল্যায়নস্বরূপ ১৯৫২ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত জেনেভাস্থ জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক আইন সভার চেয়ারম্যান ছিলেন। ১৯৫৭ সালে জাতীয় অধ্যাপক এবং ১৯৬০ সালে ভূষিত হন ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জাতীয় সম্মান ‘পদ্মভূষণ’ পদকে। আজীবন রবীন্দ্রভক্ত ড.পাল জড়িত ছিলেন জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সঙ্গেও। শেষ জীবনে শান্তিবাদী কর্মী হিসেবে ১৯৬৭ সালে কলকাতায় নিজগৃহে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পূর্বে ১৯৬৬ সালে জাপানের সম্রাট হিরোহিতো তাঁকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মাননা প্রথম শ্রেণীর ‘সুইহোওশোও’ (Order of the Sacred Treasure) পদকে ভূষিত করেন। ১৯৯৭ সালে ভারতের সঙ্গে জাপানের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তিতে কিয়োতো শহরের অদূরে এক পাহাড়স্থ শোওয়া-নো-মোরি নামক উদ্যানে তাঁর একটি স্মৃতিফলক স্থাপন করেন জাপানি জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দ। নেতৃত্ব দেন বিখ্যাত কিয়োসেরা কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রাক্তন চেয়্যারম্যান ড.ইনামোরি কাজুও। প্রায় দেড়শ বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান এই প্রকল্পে আর্থিক সাহায্য করে। উদ্বোধন উপলক্ষে জাপানে এসেছিলেন ড.পালের পুত্র বিশিষ্ট আইনজীবী প্রশান্তকুমার পাল (১৯২৬Ñ) সস্ত্রীক। অনুরূপ আর একটি স্মৃতিফলক স্থাপিত হয়েছে ২০০৫ সালে টোকিওর কুদানশিতা শহরে অবস্থিত ভারতীয় দূতাবাস সংলগ্ন বিতর্কিত ইয়াসকুনি শিন্তোও মন্দির প্রাঙ্গণে।
একবার জাপান সরকার তাঁর একটি আবক্ষ মূর্তি পাঠিয়েছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপন করার জন্য সেটা মোড়কসুদ্ধ গুদাম ঘরের সিঁড়ির তলে স্থান পেয়েছিল, প্রশান্তবাবুর মুখে এই কথা শুনে বিশ্বাস হচ্ছিল না দেখে একটি দৈনিক ইংরেজি পত্রিকা খুলে তৎসম্পর্কিত প্রতিবেদন দেখিয়েছেন আমাকে ২০০৬ সালে কলকাতায় তাঁর ডোবার লেনের নিরাভরণ বাসভবনে। আরও একটি তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেছিলেন তিনি তখন, নেহেরু তাঁদেরকে অনেক জ্বালিয়েছে, সর্বশান্ত করে দিয়েছে। শুনে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম কিন্তু বিস্তারিত জানার জন্য আমার সময় হাতে ছিল না। আমি না হই কেউ না কেউ একদিন অব্যক্ত সত্যকে লোকসম্মুখে উন্মোচিত করবে। নেহেরুর সঙ্গে যে ড.পালের সম্পর্ক ভালো ছিল না তা প্রমাণিত হয় ওলন্দাজ আইন বিশারদ প্রফেসর বার্ট রেলিং এর ভাষ্য থেকে যা প্রশান্তবাবুর মুখে শোনা। তিনি রেলিং এর লিখিত একটি গ্রন্থ আমাকে দেখান। আইন বিশেষজ্ঞ রেলিং ট্রাইব্যুনালের আগে মিত্রশক্তি আমেরিকার জেনারেল ডগলাস ম্যাক্-আর্থারের অনুরোধে ভারত থেকে একজন আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞের খোঁজে দিল্লি যান এবং নেহেরুকে অনুরোধ করেন তেমন কাউকে পরিচয় করিয়ে দিতে তাতে নেহেরু অপারগতা প্রকাশ করেন। পরে রেলিং নিজেই অনুসন্ধান করে আইনজীবী রাধাবিনোদ পালের খোঁজ পেয়ে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁকেই নিযুক্ত করেন ট্রাইব্যুনালে। বৃটিশ সরকার তাঁর নিয়োগে অনুমতি প্রদান করে। এটাই কী নেহেরুর ঈর্ষার কারণ হয়ে উঠেছিল? তার জবাব এখনো পাওয়া যায়নি। কিন্তু ৬০-৭০ এর দশকে দীর্ঘদিন জাপানে বসবাসকারী ভারতীয় বাঙালি ব্যবসায়ী বর্তমানে দিল্লিস্থ ‘উন্মুক্ত উচ্ছাস’ সাহিত্য সাময়িকীর সম্পাদক ও প্রকাশক বিকাশ বিশ্বাস তাঁর জাপান অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখিত ‘উদিত ভানুর দেশ জাপান’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘টোকিও ট্রাইব্যুনালে বিচারপতি পালের রায় নিয়ে নেহেরু অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। তিনি আশা করেছিলেন আমেরিকা তথা শ্বেতাঙ্গদের প্রত্যাশার সঙ্গে মিল রেখে রায় দেবেন। কিন্তু দিয়েছেন সম্পূর্ণ উল্টো। এই নিয়ে দীর্ঘদিন তাঁদের মধ্যে তর্কবিতর্ক, মনোমালিন্য চলেছিল।’ নেহেরু কি মনেপ্রাণে শ্বেতাঙ্গপন্থী ছিলেন? তাঁর চিন্তা ও কর্মকাণ্ডে অলঙ্ঘনীয় বৃটিশ প্রভাব ছিল বলে তো অনেকেই মনে করেন। ১৯৬৪ সালে তাঁর মৃত্যুর পর একটি বৃটিশ পত্রিকা বলেছিল, ‘এর পর থেকে একজন ভারতীয় (ইন্দিরা গান্ধী) ভারত শাসন করবেন!’ মন্তব্যটি তাৎপর্যপূর্ণ।
তবে এটা ঠিক যে বিচারপতি পাল প্রদত্ত রায়ের কিছু কিছু বিষয় নিয়ে এখনো বিতর্ক আছে। তাঁর রায়কে কতিপয় জাপানি বুদ্ধিজীবী অদলবদল করে যথেচ্ছ ব্যবহার করেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। তেমনি বহু বিতর্ক আছে টোকিও মিলিটারি ট্রাইব্যুনালের আয়োজনকে ঘিরেই। বিচারপতি ড.পাল এটাকে ট্রাইব্যুনালই মনে করেননি! তাঁর এই অনুধাবনের সমর্থনকে ক্রমাগত জোরালো করে তুলছে সাম্প্রতিককালে দেশ-বিদেশে উন্মুক্ত, আবিষ্কৃত গুরুত্বপূর্ণ অজ্ঞাত তথ্য-উপাত্তসমূহ।
বর্তমানকালের কতিপয় গবেষকের দৃঢ় বিশ্বাস যে, উক্ত বিচারের চিন্তাভাবনা ও আয়োজনে ১০টি বিরাট ভুল বা বিভ্রান্তি কিছু গবেষক তৎক্ষণাৎ এবং পরবর্তীকালে তুলে ধরেছিলেন। এর মধ্যে প্রধান একটি ভুল হচ্ছে ‘ব্যক্তির প্রতি আক্রোশ।’ একটি মহাযুদ্ধ সংঘটনের জন্য একটি জাতি দায়ী থাকে। সেই জাতির প্রধান পরিচালক একা কিছু সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না রাষ্ট্র পরিচালনায় নিযুক্ত পারিষদবর্গ ছাড়া। জাপানের ক্ষেত্রে আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা বা লিপ্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জেনারেল তোজো হিদেকি একা নিয়েছিলেন বলে সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তাঁর সঙ্গে ছিল সমগ্র মন্ত্রী পরিষদ এবং সবার উপরে রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী শোওয়া-সম্রাট হিরোহিতো। কিন্তু টোকিও ট্রাইব্যুনালে সম্রাটকে বাইরে রেখে তোজোকে প্রধান করে পুরো মন্ত্রী পরিষদ এবং কতিপয় বুদ্ধিজীবীকে আসামি করা হয়েছিল। তিনটি শ্রেণী করা হয়েছিল এ.বি.সি. নামে। ‘এ’ হল শান্তিভঙ্গ, ‘বি’ হল যুদ্ধপরাধ, ‘সি’ হল মানবতাবিরোধী। টোকিও ট্রাইবুন্যালে শুধুমাত্র ‘এ’ চিহ্নিত অপরাধীদের বিচার করা হয়েছিল ‘বি’ ও ‘সি’ চিহ্নিত অপরাধীদের বিচার অনুষ্ঠিত হয়নি; অপরাধী সর্বমোট ২৮ জন। তিন জন বিভিন্ন কারণে মারা যাওয়ায় আঠাস জনকে শাস্তি প্রদান করা হয়েছিল যৌথ রায়ের মাধ্যামে। তাও আবার গুরুতর অপরাধের জন্য তোজোসহ সাত জনের ফাঁসি বাকিরা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিলেন। আবার কেউ কেউ গুরুতর অপরাধী হিসেবে বিচার থেকে ফসকে গেছেন, দণ্ডপ্রাপ্ত কারাবন্দী হিসেবে কারাগার থেকে দ্রুত মুক্তিও পেয়েছেন। কিন্তু যে ঐতিহাসিক ঘটনার জন্ম দিয়েছিলেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জেনারেল তোজো হিদেকি বিনাবাক্যে ফাঁসির দণ্ডাদেশ মাথা পেতে নিয়ে অর্থাৎ সম্রাটকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন তার নজির ইতিহাসে একেবারেই বিরল। জাতি ও রাষ্ট্রপরিচালকের প্রতি এমন আনুগত্যের দৃষ্টান্ত একমাত্র তোজো হিদেকিই দেখিয়ে গেছেন। সত্তর বছর পর ইতিহাস আজ তাঁর এই অসামান্য দৃষ্টান্তকে স্বীকার করে নিতে ঘুরে দাঁড়িয়েছে বলেই মনে হয় সা¤প্রতিককালে বিস্তর গুপ্ত তথ্যাদির ভাণ্ডার উন্মোচনের ফলে । এই বিচারটি শেষ করতেই আড়াই বছর (৩ মে, ১৯৪৬-১২ নভেম্বর, ১৯৪৮) সময় লেগেছিল মিত্রশক্তির। এই আড়াই বছর টোকিও ইম্পেরিয়াল হোটেলের কক্ষে বসে নিরলসভাবে আন্তর্জাতিক আইন, জাপানি ইতিহাসবিষয়ক গ্রন্থাদি পাঠ ও গবেষণা করেছেন বিচারপতি ড.পাল। যা আর এক নজিরবিহীন ঘটনা!
প্রশ্ন হচ্ছে যে, কেন মিত্রশক্তি সম্রাটকে প্রকাশ্যে দায়ী করতে পারেনি তার একমাত্র কারণ–সেই ক্ষমতা তাদের ছিল না। তখনকার পরিপ্রেক্ষিতে সম্রাট জাপানের ঐক্যের প্রতীক তথা ‘কামিসামা’ বা ‘ঈশ্বর’ হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত ছিলেন। তাঁকে আদালতে টেনে আনার অর্থ হচ্ছে ‘ঘুমন্ত সামুরাই যোদ্ধাদের’কে জাগিয়ে তোলা। জাপানিরা সব লণ্ডভণ্ড করে দেবার মতো তখনো যথেষ্ট শক্তিধর ছিলÑÑযুদ্ধে স্বেচ্ছায় পরাজয় বরণ করার পরও। উল্লেখ্য যে, আণবিক বোমাও তারা উদ্ভাবন করে ফেলেছিলেন কিন্তু সম্রাটের নির্দেশে তা ব্যবহার থেকে বিরত থাকেন, কারণ হিরোশিমা-নাগাসাকির পর আর অহেতুক মানুষ নিধন সম্রাট দেখতে চাননি। কিন্তু মিত্রশক্তির দুই প্রধান রাষ্ট্র আমেরিকা ও বৃটেন জাপানের এই মনোভাবকে আদৌ বিবেচনায় না এনে একটি সুদূরপ্রসারী উদাহরণ স্থাপন করার লক্ষ্যে টোকিও মিলিটারি ট্রাইব্যুনালের আয়োজন করেছিলেন এবং এর জন্য প্রয়োজন ছিল এমন একজন মানুষের যাকে সহজে ফাঁসানো যায়—তিনি ছিলেন যুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী সম্রাট-অনুগত জেনারেল তোজো হিদেকি। কাজেই দেখা যাচ্ছে যে, ব্যক্তি বিশেষ ছিল মিত্রশক্তির মূল লক্ষ্য। মূল যুদ্ধাপরাধী হিসেবে যদি ধরা হয় তাহলে অনেককেই বিচারের আওতায় আনা হয়নি রহস্যজনকভাবে। যেমন নোবুসুকে কিসি তিনি তোজোর মন্ত্রীসভায় বাণিজ্যমন্ত্রী ছিলেন; জাপান কর্তৃক চীনে প্রতিষ্ঠিত মাঞ্চুকুও তথা মাঞ্চুরাজ্যের উন্নয়নবিষয়ক প্রধান কর্মকর্তাও ছিলেন। তাঁর কোনো বিচার হয়নি, বরং যুদ্ধের পর তিনি দুদুবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। ড.পালের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন তিনি। পালের প্রদত্ত রায়টি তিনিই প্রথম গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেছিলেন জাপানি ভাষায়। এমনি আরও অনেকেই পার পেয়ে গেছেন। মোদ্দাকথা, তোজো হিদেকির উপর ছিল মিত্রশক্তিপ্রধান আমেরিকার রাজরোষ। কারণ এটা সত্য যে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের পক্ষ হয়ে তিনি বাধ্য হয়ে হাওয়াইই দ্বীপস্থ মার্কিন নৌঘাঁটি পার্লহার্বার উড়িয়ে দিয়ে আমেরিকার বিরুদ্ধে প্রশান্ত মহাসাগরীয় বা মহাএশিয়া যুদ্ধের সূচনা করেছিলেন। বাধ্য হয়ে বলা এই কারণে যে, এমনভাবে জাপানকে আমেরিকাসহ শ্বেতাঙ্গ শক্তি ক্রমে ক্রমে চাপ প্রয়োগ করে দেয়ালে ঠেকিয়ে ধরেছিল যে, আপন অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্য জাপানকে ঘুরে দাঁড়াতে হয়েছিল। রাষ্ট্রের অনুমতিক্রমেই প্রধানমন্ত্রী, সেনাপতি হিসেবে তোজো যুদ্ধঘোষণাপত্র পাঠিয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু রহস্যজনকভাবে সেটা এক ঘন্টা বিলম্বে মার্কিন কর্তৃপক্ষের হাতে পৌঁছেছিল। এর মধ্যে নৌবাহিনী প্রধান ইয়ামামোতো ইসোরোকু আক্রমণ করে বসেন পার্লহার্বার। ফলে ঘটনাক্রমে তোজো হিদেকিকেই আমেরিকা দায়ী করে পার্লহার্বার আক্রমণের জন্য। যদিও এটা ছিল ষড়যন্ত্রমাত্র। এবং বিচারপতি রাধাবিনোদ পাল স্পষ্টতই বুঝতে পেরেছিলেন যে, আমেরিকাই যত নাটের গুরু। তাই ১৯৪১ সালের ৮ ডিসেম্বর জাপান আমেরিকাকে আক্রমণ করলে প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডিলানো রুজভেল্টের পরিকল্পনা পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয় যুদ্ধে সংযুক্ত হওয়ার। কারণ আমেরিকারও তখন যুদ্ধে জড়িত না হলে দীর্ঘদিনের লাগাতার ভয়ানক অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব ছিল না। যুদ্ধ লাগলেই বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র, খাদ্য-পণ্য উৎপাদিত হবে, কাজের ও আয়ের অভাব হবে না অর্থাৎ ওয়ারমেশিন চালু হবে, এটাও ছিল অন্যতম প্রধান লক্ষ্য প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের। তাই জাপান যখন আমেরিকার ব্যবসায়ী অংশীদার চীন আক্রমণ করে এবং মিত্রদেশ বৃটিশের উপনিবেশ ভারতকে প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতার হাত এগিয়ে দেয় ঘাবড়ে যায় বৃটেন আর আমেরিকা ফলে দ্রুত পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তৎপর হয়ে ওঠে। আমেরিকা জাপানকে চাপ প্রয়োগ করে চীনের মাঞ্চুরিয়া, নানকিং (নানজিং) থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করতে। যদিও মাঞ্চুরিয়া চীনের নিজস্ব কোনো জায়গা ছিল না কোনোকালেই। উন্মুক্ত একটি জায়গায় চীনা, কোরিয়ান, রাশিয়ান এবং জাপানিরা দীর্ঘকাল ধরে বসবাস করে আসছিল। মাঞ্চুরিয়ার মূল জাতিই ছিল আলাদা গোষ্ঠীÑÑযাঁদের পরিচয় ইতিহাসে ‘কুইং’ বংশ নামে, ‘কান্’, ‘হান্’ কোনো গোষ্ঠী নয়।
প্রকৃতপক্ষে, মাঞ্চুরিয়ার উপর রাশিয়া ও জার্মানির আগ্রাসী হস্তক্ষেপ ছিল বহু আগে থেকেই। খনিজ সম্পদের জন্য মাঞ্চুরিয়া ছিল বরাবরই সমৃদ্ধ। যে কারণে আমেরিকা, বৃটেন, রাশিয়া, জার্মান ও জাপানের লক্ষ্য ছিল মাঞ্চুরিয়া। সেখানে প্রচুর পরিমাণে অর্থ বিনিয়োগ করেছিল জাপান, গড়ে তুলেছিল ভারী শিল্পকারখানা, কৃষি খামার, আধুনিক রেলপথ, বিমানবন্দর, বন্দর, হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি। যা ছেড়ে দিলে জাপানকে না খেয়ে মরতে হত–এই বাস্তবতা যে আমেরিকা জানত না তা নয়। জাপানকে নাস্তানাবুদ করার জন্য আমেরিকা চীনা জাতীয়তাবাদী দল প্রধান চিয়াং কাই-শেককে (Chiang Kai-shek) আর্থিকভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। অনুরূপ রাশিয়াও সমর্থন দিয়েছিল জাতীয়তাবাদী দলকে মাঞ্চুরিয়া থেকে জাপানকে উৎখাত করতে। ইতোমধ্যে ইন্দোসিনার (মিত্রশক্তিভুক্ত ওলন্দাজ উপনিবেশ ইন্দোনেশিয়া) দিকে অগ্রসর হওয়ার কারণে আমেরিকা জাপানের সঙ্গে জ্বালানি ও দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি সব বাতিল করে দেয়। স্বরাষ্ট্র সচিব কর্ডেল হাল (Cordell Hull) কর্তৃক ২৬.১১.১৯৪১ তারিখে প্রেরিত শেষ নোট এর ভাষ্যই আমেরিকা-জাপান যুদ্ধের ঘন্টা বাজিয়ে ছিল। ওই দিনই জাপানি নৌবাহিনী হাওয়াইই এর পার্লহার্বারস্থ মার্কিন নৌঘাঁটির দিকে রওয়ানা হয়ে যায়। ৮ ডিসেম্বর নৌঘাঁটি আক্রমণ করে যুদ্ধের সূচনা করে।
এই পর্যন্ত ইতিহাস জেনে বিচারপতি পাল যা অনুভব করেন সেটা এই যে, আমেরিকা জাপানের মানবিক দিকটা কোনোদিনই বিবেচনা করেনি। জাপান সাম্রাজ্যবাদী হত না আমেরিকাই তাকে সাম্রাজ্যবাদী করেছে তার প্রয়োজনে। তবে অন্যদিকে চিন্তা করলে আমেরিকার এই ভুলের কারণে ভারতবর্ষসহ এশিয়ার দেশগুলো বৃটিশ, ফ্রান্স ও নেদারল্যান্ডস্ এর হাতছাড়া হয়েছে অর্থাৎ শ শ বছর পর এশিয়া মহাদেশ শ্বেতাঙ্গ সাম্রাজ্যবাদের করতল থেকে মুক্তিলাভ করে জাপানের উত্থানের কারণেই। এটাও তিনি ভালো করেই জানতেন। যে কারণে তিনি জাপানে মৃত্যুবরণ করতেও দ্বিধা প্রকাশ করেননি এই কারণে যে, তিনি জাপানিদের আত্মিকশক্তিটাকে ভালোবেসেছিলেন। আর একটি কারণে কৃতজ্ঞ ছিলেন আজীবন যে, স্বাধীন মাতৃভূমির যে স্বপ্ন দেখেছিলেন তরুণকালে তা পূরণ করেছিল জাপানই। ভারতও আজকে তা অকুন্ঠচিত্তে স্বীকার করছে। এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ ১৫ আগস্ট স্বাধীনতা বা প্রজতন্ত্র দিবস জাপানে ভারতীয় দূতাবাস পালন করে না, কেননা এই দিনে জাপান মিত্রশক্তি প্রধান আমেরিকার কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল অর্থাৎ পরাজয় বরণ করেছিল। জাপানের জন্য এটা দুঃখের দিন। পুরোনো ও পরীক্ষিত বন্ধু হয়ে ভারত আনন্দ করে কিভাবে? অনেকে মনে করেন রাজপ্রাসাদের পাশে ভারতীয় দূতাবাসের অভাবনীয় মূল্যবান জায়গাটি ভারত পেয়েছে বিচারপতি রাধাবিনোদ পালের প্রতি জাপানের কৃতজ্ঞতার উপহার হিসেবে বিনামূল্যে। বিচারপতি পাল তথাকথিত টোকিও ট্রাইব্যুনালকে অস্বীকার এবং ‘বিজিতের বিজয়’ বলে উপহাস করেছেন ফলে অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধী আঠাস জন তাঁর দৃষ্টিতে বা বিচারে নির্দোষ বিবেচিত হয়েছিলেন। এর সুদূর প্রসারী ফল যেটা হয়েছে সেটা হল: জাপানি ‘ন্যাশনালিস্ট’দের শুষ্ককন্ঠ তিনি পুনরায় আর্দ্র জাতীয়তাবোধে সিক্ত করেছেন, পুনর্বার যুদ্ধবিধ্বস্ত অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়াতে অপরিসীম অনুপ্রেরণা ও সাহস জুগিয়েছেন যতবার জাপান এসেছেন মৃত্যু পর্যন্ত। তাঁর ভিন্নমতালম্বী রায়টি ব্যাপকভাবে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়াতে ট্রাইব্যুনালের আয়োজক জেনারেল ডগলাস ম্যাক-আর্থার পর্যন্ত কেঁপে উঠেছিলেন, আমেরিকায় ফিরে গিয়ে কংগ্রেসের সভায় টোকিও ট্রাইব্যুনাল ছিল ভুল বিচার বলে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলেন। বলা যেতে পারে যে, জাপানকে রক্ষার জন্যই যেন বিচারপতি পালের আবির্ভাব ঘটেছিল। যে কারণে বহু সচেতন জাপানি বিশ্বাস করেন যে, বিচারপতি রাধাবিনোদ পাল জাপানিদের ‘ইনোচি নো ওনজিন’ বা জাপানিদের ‘জীবনদাতা’।
টোকিও মিলিটারি ট্রাইব্যুনাল ছিল বিচারপতি রাধাবিনোদ পালের জীবনে একটি বিরাট সুযোগ। এই সুযোগ তিনি পুরোমাত্রায় সদ্ব্যবহার করেছিলেন যেমন:
এক] জাপানকে সাম্রাজ্যবাদী বলে মিত্রশক্তি যেভাবে অপরাধী করেছে তার প্রতিত্তোরে এশিয়ায় প্রথম অত্যাচারী সাম্রাজ্যবাদী শ্বেতাঙ্গশক্তি বৃটিশ, ওলন্দাজ, ফরাসী, স্পেইন, পর্তুগীজ যে ছিল তা মুক্তকন্ঠে বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিয়েছেন।
দুই] যে কারণে এশিয়ায় গণহত্যার জন্য জাপানকে নাৎসির সঙ্গে তুলনা করেছে মিত্রশক্তি একই কারণে হিরোশিমা, নাগাসাকিতে আণবিক বোমা নিক্ষেপ করে লক্ষ লক্ষ নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করার জন্য আমেরিকারও বিচার দাবি করেছেন তিনি।
তিন] যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার জন্য যেখানে কোনো আন্তর্জাতিক আইন ছিল না মিত্রশক্তি নিজেরা আইন তৈরি করে জাপানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেছে তা ছিল সম্পূর্ণ অবৈধ এবং প্রহসন বলে মন্তব্য করেছেন। তাঁর এই সুচিন্তিত রায়ের কারণেই যুদ্ধাপরাধীদের জন্য আন্তর্জাতিক আইন প্রণয়নে জাতিসংঘ পরে উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। আজ সেই আইনই আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ আইনের মূল ভিত্তি।
চার] জাপান-বাংলা-ভারতের ত্রিমাত্রিক সম্পর্কের মূল ভিত্টাকে নতুন করে শক্তিশালী এবং সুদূরপ্রসারী করেছিলেন তিনি। যার ফলাফলই কলকাতায় সদ্য প্রতিষ্ঠিত ‘ভারত-জাপান সংস্কৃতি কেন্দ্র’–যার জাঁকজমকপূর্ণ উদ্বোধন করেছেন ২০০৭ সালে তৎকালীন জাপানি প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে যিনি প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী কিশি নোবুসুকের নাতি। এই সফর ছিল তাঁর একটি ঐতিহাসিক সফর–বিচারপতি পালের পুত্র প্রশান্ত পালের সঙ্গে, নেতাজির আত্মীয়া কৃষ্ণা বসুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। দিল্লির সংসদে অকুণ্ঠ চিত্তে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন টোকিও ট্রাইব্যুনালে বিচারপতি পালের প্রদত্ত ঐতিহাসিক রায়ের জন্য।
সাম্প্রতিককালে বিচারপতি ড.পালের কতিপয় জাপানি ভক্ত কুষ্টিয়া সফর করেছেন তাঁর জন্মস্থানে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণের পরিকল্পনায়। বিচারপতি পাল এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও মৃৎশিল্পী এবং মর্যাদাসম্পন্ন প্রাচীন প্রকাশনা সংস্থা ‘হেইবোনশা পাবলিশার’ এর প্রতিষ্ঠাতা শিমোনাকা ইয়াসুবুরো–দুজনের একনিষ্ঠ শিষ্য লেখক ও গবেষক স¤প্রতি প্রয়াত তানাকা মাসাআকি তাঁদের মূল্যবান স্মৃতি রক্ষার্থে ১৯৭৪ সালে ‘শিমোনাকা-পাল মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশন’ জাদুঘর প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিলে পরে শিমোনাকা ফাউন্ডেশন সেটি স্থাপন করে কানাগাওয়া-জেলার নয়নাভিরাম হাকোনো শহরের এক পাহাড়ে।
প্রশ্ন হচ্ছে, জাপানিরাই শুধু করবে আমরা কী কিছুই করতে পারি না এই মহান বাঙালি ব্যক্তির স্মৃতির সম্মানার্থে পশ্চিমবঙ্গে কিংবা বাংলাদেশে?

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটেগরিতে আরো খবর
Japan Bangla Press © 2025. All Rights Reserved.
Built with care by Pixel Suggest