শিশির ভট্টাচার্য্যের কার্টুন যেদিন পত্রিকায় ছাপা হয়, সেদিন সে-পত্রিকাটি একটি বিশেষ সংখ্যায় পরিণত হয়। পাঠক পত্রিকা হাতে নিয়েই মনোযোগ দেন কার্টুনের দিকে। কারণ তিনি জানেন শিশির ভট্টাচার্য্যের কার্টুনে চলমান আলোচিত ইস্যুটি তার মনের মতো করেই আঁকা হয়েছে। এমনিভাবে শিল্পের মাধ্যমে যে সমাজের অসংগতি গুলোকে তুলে ধরা যায় এবং অন্যায়ের প্রতিবাদ করা যায় শিশির ভট্টাচার্য্যের চিত্রশিল্প ও কার্টুন তার উজ্জ্বল উদাহরণ। শিল্পের মাধ্যমে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার প্রত্যয়ে দীপ্ত আপোষহীন এই শিল্পী হচ্ছেন ঠাকুরগাঁও জেলার কৃতি সন্তান চিত্রশিল্পী, শিক্ষাবিদ ও কার্টুনিস্ট শিশির ভট্টাচার্য্য।
শিল্পী শিশির ভট্টাচার্য্যের জন্ম ১৯৬০ সালের (২ বৈশাখ), ঠাকুরগাঁও জেলায়। শৈশব কেটেছে সেখানেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা ইনস্টিটিউট ( বর্তমান চারুকলা অনুষদ) থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন ১৯৮৩ সালে। তিনি মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে। দেড় বছর পড়ার পর স্কলারশীপ নিয়ে চলে যান ভারতের বরোদায়। বরোদা এম এস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ক্রিয়েটিভ পেইনটিং’ বিষয়ে মাস্টার্স করেন ১৯৮৭ সালে।
দেশে ফিরে ১৯৮৮ সালে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে। সেখানে অধ্যাপনা করেন দীর্ঘ সময়।
শিশির ভট্টাচার্য্যের সাধারণ মানুষের কাছে পরিচিতি কাটুনিষ্ট হিসেবে। সেটা তাঁর অসাধারণ বুদ্ধিদীপ্ত রেখার জন্যই। আবার ক্যানভাসে তিনি ভিন্ন এক শিশির ভট্টাচার্য্য।
‘তিনজনের প্রতিকৃতি’ তাঁর অনন্য এক কাজ। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের তিন ঘৃণীত ব্যাক্তি মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ, আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খান। শিশির ভট্টাচার্য্যের আঁকা এই মুখগুলো দেখে আপনার ঘৃনা আসবেই। শিশির ভট্টাচার্য্যে অসাধারণ সিরিজ ‘খেলা দেখে যান বাবু’। সামাজিক ও রাজনৈতিক নানা অসংগতি নিয়ে ফ্যান্টাসি রয়েছে তাঁর এই সিরিজে।
বর্তমানে তাঁর ক্যানভাসে মানুষ, প্রকৃতি, প্রাকৃতিক উপাদান নানা রূপে স্থান করে নিয়েছে। তবে সেটা একটা কালার সারফেক্সে শুধু ব্লাক লাইনে। একুশের আলপনার পাশাপাশি কেন্দ্রিয় শহীদ মিনারে পাশে দেয়ালচিত্র হয়। সেখানে শিক্ষক আবাসিক এলাকায় দেয়ালে ভাষা নিয়ে নানা রকম বাণী চিত্রিত হয়। সেই বাণীর মধ্যেখানে বড় একটা জায়গা নিয়ে থাকে লাল জমিনের ওপর কালো রেখার অসাধারন চিত্রকর্ম। তার উপরের দিকে লেখা থাকে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’। প্রায় এক যুগেরও বেশী সময় ধরে এই দেয়ালচিত্রটি করেছেন শিশির ভট্টাচার্য্য।
কার্টুনিস্ট শিশির ভট্টাচার্য্য:
শিশির ভট্টাচার্য্য মূলত একজন কার্টুনিস্ট হিসেবেই বেশি পরিচিত। আশির দশকে ছাত্রাবস্থায় তিনি কার্টুন করতে শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে সামরিক সরকারের সময়কালে প্রতিবাদী কার্টুন করেন। নব্বইয়ের দশকে সংবাদপত্রে কার্টুনিস্ট হিসেবে তার প্রকাশ হয়। তার অঙ্কিত রাজনৈতিক কার্টুনগুলো মূলধারার দৈনিকগুলো সহ বাংলাদেশের জনপ্রিয় সব সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়।
১৯৮০ সাল থেকেই তার শিল্পকর্মে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সমালোচনা বিদ্রুপাত্মক শৈলীতে প্রকাশ পেয়ে আসছে। বাংলাদেশের দৈনিক পত্রিকাগুলোতে তার রাজনৈতিক কার্টুনগুলো নিয়মিত প্রকাশিত হতো। তিনি দেশের রাজনৈতিক বিষয়কে কার্টুনের বলিষ্ঠ অথচ সহজ রেখা আর বিদ্রুপের ভঙ্গিতে সাবলীলভাবে জনগণের কাছে উপস্থাপন করার প্রয়াশ চালিয়েছেন।
চলমান ব্যক্তি বা রাষ্ট্রীয় জীবনের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ বা জিজ্ঞাসা একটি কার্টুনেই প্রকাশ করতে পারেন তিনি, এ প্রতীতি সেই সময় যারা সংবাদপত্রের নিয়মিত পাঠক ছিল তাদের মনে জন্মেছিল। শিশির ভট্টাচার্য্য কার্টুনকে নিয়ে গেছেন শিল্পের এক বিশেষ দরজায়। তার কার্টুন রাজনৈতিক প্রতিবাদ, ব্যক্তিগত ও সামাজিক শ্লেষ, ক্ষোভ, ঘৃণা – সবকিছু। সবার উপরে এটি একটি শিল্প, যে শিল্প দীর্ঘদিনের চর্চা ও অভ্যাসে শিশির ভট্টাচার্য্য অর্জন করেছেন সুনিপুণভাবে। আশির দশকে স্বৈরাচারি শাসক যখন এ দেশে অনাচারের মহাতাণ্ডব চালাচ্ছিল, তখন শিশির ভট্টাচার্য্য তার এই শৈল্পিক প্রতিবাদ নিয়ে এগিয়ে এলেন। একাই জনগণের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ ও প্রতিবাদ তার কার্টুনে উদ্ভাসিত হয়ে উঠতে থাকলো। দেশবন্ধু, পূর্বাভাস, একতা, আজকের কাগজ প্রভৃতি পত্রিকায় ক্লান্তিহীন কার্টুন এঁকে তিনি স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনকে উজ্জীবিত করেছেন।
শিশির ভট্টাচার্য্যের চিত্রকর্ম নিয়ে সর্বপ্রথম একক প্রদর্শনী হয় ১৯৯৪ সালে চট্টগ্রামে। এরপর তার দ্বিতীয় একক প্রদর্শনী হয় ঢাকায় ২০০০ সালে। তিনি ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টারে আর্ট সাউথ এশিয়ার আওতায় কর্মসূচীর একটি গ্রুপ প্রদর্শনীতে অংশ নেন। তিনি পাকিস্তানের একটি গ্রুপ প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেন। ২০০৭ সালে জাপানে শিশির ভট্টাচার্য্যের একটি এক মাসের দীর্ঘ প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়।
শিশির ভট্টাচার্য্য বাংলাদেশের চিত্রকলা আন্দোলনে বিশিষ্ট ও খ্যাতিমান হয়ে উঠেছেন সময়, রাজনীতি ও সমকালীন জীবনধারাকে ব্যঙ্গ ও বিদ্রুপের মাধ্যমে চিত্রায়ণের কৌশলে ও অভিনবত্বে। তাঁর চিত্রায়ণে তিনি সর্বদা সমাজের বাস্তবতাকে বৃহৎ পরিপ্রেক্ষিত – জ্ঞানে অঙ্কনে প্রয়াসী। তাঁর এই প্রয়াস অব্যাহত থাকবে এমন প্রত্যাশাই শিল্পপ্রমীদের মনে।
Leave a Reply