মঙ্গলবার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গাজায় জরুরি ভিত্তিতে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে ‘বেসামরিকদের সুরক্ষা এবং আইনগত ও মানবিক বাধ্যবাধকতাকে সমুন্নত রাখা’ শীর্ষক একটি প্রস্তাব তোলা হয়। প্রস্তাবটি উত্থাপনের পর বিশ্বের বৃহত্তম এ সংস্থার ১৯৩টি সদস্যরাষ্ট্রের মধ্যে ১৫৩টি-ই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়। এসব সদস্যরাষ্ট্রের মধ্যে ভারতও ছিল।
পরে জাতিসংঘে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি রুচিরা কম্বোজ সাংবাদিকদের জানান, যুদ্ধের শুরুর দিকে কী কারণে ভারত ইসরায়েলকে সমর্থন করেছিল এবং এখন কোন কারণে গাজায় যুদ্ধবিরতির পক্ষে অবস্থান নিয়েছে।
রুচিরা বলেন, ‘ভারত জাতিসংঘে গাজায় যুদ্ধবিরতির পক্ষে ভোট দিয়েছে। বর্তমানে গাজায় যে পরিস্থিতি চলছে, তার অনেকগুলো মাত্রা রয়েছে। গত ৭ আগস্ট ইসরায়েলে সন্ত্রাসী হামলা হয় এবং বেশ কয়েকজন জিম্মিকে ধরেও নিয়ে যাওয়া হয়। ভারত সবসময়েই যে কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও তৎপরতার বিরুদ্ধে।’
‘কিন্তু বর্তমানে গাজার পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠেছে এবং প্রতিদিন সেখানে শত শত বেসামরিক মানুষ নিহত হচ্ছেন। ভারত মনে করে শান্তিপূর্ণভাবে এই যুদ্ধপরিস্থিতি থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় দ্বিরাষ্ট্র সমাধান, যার দাবি ফিলিস্তিন দীর্ঘদিন ধরে জানিয়ে আসছে।’
রুচিরা আরও বলেন, ‘এ যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক রাজনীতির ভারসাম্যে যে টালমাটাল অবস্থা দেখা দিয়েছে, তা আমলে নিয়ে আমরা বলতে পারি— বর্তমানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় একটি নজিরবিহীন কঠিন সময় পার করছে। আমরা সবাই এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ চাই এবং এ কারণেই জাতিসংঘ সনদের ৯৯ নম্বর নম্বর ধারার ভিত্তিতে মহাসচিব (আন্তোনিও গুতেরেস) যে প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন, তাতে সমর্থন জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারত।’
মঙ্গলবার সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে প্রস্তাবটি উত্থাপনের পর সেটির পক্ষে ভোট পড়ে ১৫৩টি। বাকি ৩০টি রাষ্ট্রের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল, অস্ট্রিয়াসহ ২৩টি রাষ্ট্র যুদ্ধবিরতির বিপক্ষে ভোট দিয়েছে এবং ভোটদান থেকে বিরত থেকেছে আর্জেন্টিনা, ইউক্রেন, জার্মানিসহ ১০টি দেশ।
গত ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার নিয়ন্ত্রণকারী গোষ্ঠী হামাসের যোদ্ধারা ইসরায়েলের ভূখণ্ডে অতর্কিত হামলা চালানোর পর ওই দিন থেকেই গাজায় অভিযান শুরু করে ইসরায়েলি বিমান বাহিনী। পরে ১৬ অক্টোবর থেকে অভিযানে যোগ দেয় স্থল বাহিনীও।
ইসরায়েলি বাহিনীর টানা দেড় মাসের অভিযানে কার্যত ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে গাজা উপত্যকা, নিহত হয়েছেন ১৮ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি। নিহত এই ফিলিস্তিনিদের মধ্যে নারী ও শিশুর সংখ্যা ১২ হাজারেরও বেশি।
অন্যদিকে, হামাস যোদ্ধাদের হামলায় ইসরায়েলে নিহত হয়েছিলেন ১ হাজার ২০০ জন ইসরায়েলি ও অন্যান্য দেশের নাগরিক। পাশাপাশি, ইসরায়েলের ভূখণ্ড থেকে ২৪২ জন ইসরায়েলি ও অন্যান্য দেশের নাগরিকদের ধরে নিয়ে গিয়েছিল হামাস যোদ্ধারা।
দেড় মাসেরও বেশি সময় যুদ্ধের পর অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক চাপের মুখে নতি স্বীকার করে গত ২৫ নভেম্বর অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী আইডিএফ এবং হামাস। গত নভেম্বরের মাঝামাঝি যুদ্ধের অন্যতম মধ্যস্থতাকারী দেশ কাতারের মাধ্যমে ইসরায়েলের যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভা বরাবর একটি প্রস্তাব পাঠিয়েছিল হামাসের হাইকমান্ড।
সেই প্রস্তাবে গোষ্ঠীটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ইসরায়েল যদি গাজা উপত্যকায় চার দিনের যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে, রাফাহ ক্রসিংয়ে অপেক্ষারত ত্রাণ, জ্বালানি ও মানবিক সহায়তা পণ্যবাহী ট্রাকগুলোকে প্রবেশ করতে দেয় এবং ইসরায়েলি কারাগারগুলো থেকে অন্তত ১৫০ জন বন্দিকে মুক্তি দেয়, তাহলে নিজেদের হাতে থাকা জিম্মিদের মধ্যে থেকে ৫০ জনকে ছেড়ে দেবে হামাস।
সেই প্রস্তাব মেনে নিয়ে ২৫ নভেম্বর চার দিনের যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে ইসরায়েল। পরে যুক্তরাষ্ট্র, কাতার, মিসর, ইউরোপ ও অন্যান্য মধ্যস্থতাকারীদের তৎপরতায় যুদ্ধবিরতির মেয়াদ আরও তিন দিন বাড়ানো হয়।
যুদ্ধবিরতির ৭ দিন ২৫-৩০ নভেম্বর পর্যন্ত মোট ৯৪ জন জিম্মিকে মুক্তি দিয়েছে হামাস। বিপরীতে ইসরায়েলের বিভিন্ন কারাগার থেকে ১৮০ জনকে ছেড়ে দিয়েছে ইসরায়েলও।
১ ডিসেম্বর ভোর থেকে হামাস ও ইসরায়েলি বাহিনীর হামলা-পাল্টা হামলার মধ্যে দিয়ে শেষ হয় এক সপ্তাহের যুদ্ধবিরতি।
সূত্র : এনডিটিভি
Leave a Reply