1. editor1@japanbanglapress.com : editor1 :
  2. japanbanglapress@japanbanglapress.com : japanbanglapress :
  3. mdzahidulislam1000@gmail.com : zahid :

মুক্তিযুদ্ধের শিল্পকলা

  • আপডেটের সময় : সোমবার, ২৫ ডিসেম্বর, ২০২৩
বিজ্ঞাপন
দীপংকর গৌতম

আমাদের মহান স্বাধীনতা ত্রিশ লাখ মানুষের রক্ত ও ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত। দেশকে হানাদার মুক্ত করতে মরণপণ লড়াইয়ে অংশ নেয় রাজনৈতিক কর্মী, ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, পেশাজীবী, শিল্পী সংগ্রামী নির্বিশেষে সকল শ্রেণির মানুষ। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণ ও গণহত্যা মোকাবিলার জন্য গড়ে তোলে প্রতিরোধ। সশস্ত্র যুদ্ধের পাশাপাশি মননশীলতার মধ্য দিয়েও যুদ্ধকে গতিশীল করা হয়। গঠিত হয় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ও সংস্কৃতিকর্মীদের বিভিন্ন সংগঠন। অন্যান্য পেশাজীবীদের মতো চিত্রশিল্পীরা শামিল হয় জনযুদ্ধে।

শিল্পীর দায়বদ্ধতার প্রশ্ন কত বড় সেটাকে আত্মস্থ  করেই-সময়ের দাবি পূরণ করতে শিল্পীরা মানুষের চেতনায় প্রতিবাদের ভাষা জুড়ে দিতে নেমে পড়ে মাঠে। বিশ্বখ্যাত লেখক মিলান কুন্ডেরা বলেছেন, ‘ক্ষমতার বিরুদ্ধে মানুষের সংগ্রাম হচ্ছে- বিস্মৃতির বিরুদ্ধে স্মৃতির সংগ্রাম।’ আত্মদানের প্রতিজ্ঞায় দীপ্ত দীর্ঘ ধারাবাহিক অভিযাত্রা ছিল আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে দেশের শিল্পী সমাজ মুক্তিযুদ্ধে নানাভাবে অংশ নিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে তাদের রঙ-তুলি মারণাস্ত্রের চেয়েও কোনো কোনো সময় বেশি কাজ করেছিল। তা ছাড়া অনেক শিল্পী রঙ তুলি রেখে অস্ত্র হাতেই শত্রুর বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। শিল্পী শাহাবুদ্দীনের নাম তাদের মধ্যে অন্যতম। একাত্তরের এপ্রিল মাসে তিনি খালেদ মোশাররফের অধীনে দুই নম্বর সেক্টরে গেরিলা ট্রেনিংয়ে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি ও আবুল বারক আলভী ছিলেন পাকিস্তানি বাহিনীর আতঙ্ক ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্য। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে তিনি শাহবাগ রেডিও স্টেশনে ঢুকে পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়িয়ে দেন। আবুল বারক আলভী শিল্পী সংগ্রামী একুশের গানের সুরকার আলতাফ মাহমুদের বাসা থেকে বর্বর হানাদার বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। তার ওপর চলে অবর্ণনীয় নির্যাতন। আরও যেসব শিল্পী মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ করেছিলেন তারা হলেন শাহাদাত চৌধুরী (বিচিত্রা সম্পাদক), জি এম এ রাজ্জাক, হরিহর সরকার, মইনুল হোসেন, সৈয়দ সালাউদ্দিন চৌধুরী, এম এ খালেক, গোলাম কিবরিয়া চৌধুরী, জি এম খলিলুর রহমান, স্বপন আচার্য, ইয়াকুব খান, মজিবুর রহমান সিরজুদ্দিন, বনিজুল হকসহ অনেকে।

১৯৭১ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে পাকিস্তানি বর্বর বাহিনীর অত্যাচারকে তুলি ও কলমে তুলে ধরে এক প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। ওই প্রদর্শনীতে ১৭ (সতেরো) জন শিল্পীর ৬৬টি শিল্পকর্ম স্থান পায়। ঐতিহাসিক এই প্রদর্শনী দেখেই বিশ্ববাসী বাংলার দুরবস্থার কথা জানতে পেরেছিল। প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণকারী শিল্পী ও তাদের ছবির শিরোনামগুলো হলো-গোলাম মোহাম্মদ- ‘সূর্য বিলোপ’, অঞ্জন বণিক- ‘রক্তাক্ত বাংলাদেশ’, বীরেন সোম- ‘কান্না’, ‘দুঃস্বপ্ন’, চন্দ্রশেখর দে- ‘নিষ্পাপ শিকার’, ‘চঞ্চল পাখি’, মুস্তাফা মনোয়ার- ‘গর্বিত মা’, ‘নারী এবং পশু’, নাসির বিশ্বাস- ‘ধর্ষণ’ ইত্যাদি।

মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণাদানকারী শিল্পীদের মধ্যে পটুয়া কামরুল হাসান এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। মুক্তিযুদ্ধে তার অবদান অনস্বীকার্য। ১৯৭১-এর মার্চে স্বৈরাচারী শাসক ইয়াহিয়া খান যখন নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ফ্যাসিস্ট কায়দায় গণহত্যা শুরু করেছিল, তখন তিনি বেদনা, ক্ষোভ আর ক্রোধে জ্বলে উঠে ‘ইয়াহিয়া এই জানোয়ারটা আবার আক্রমণ করতে পারে’ শিরোনামে ১০টি পোস্টার আঁকেন। পোস্টারগুলো শহীদ মিনারে জনসাধারণের জন্য প্রদর্শন করা হয়। যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে কামরুল হাসান পশ্চিমবঙ্গে চলে যান এবং নবগঠিত মুজিবনগর সরকারের তথ্য ও প্রচার বিভাগের প্রধান দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তখন তিনি ইয়াহিয়া খানের প্রতিকৃতি দিয়ে একটি বিখ্যাত ব্যঙ্গচিত্র আঁকেন, ‘এই জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে’ শিরোনামে। সেখানে দানব আকারে দেখানো হয় ইয়াহিয়াকে, যা প্রকৃত অর্থে পুরো হানাদার বাহিনীর নগ্ন চরিত্রের পরিচয় বাহক। সেই চিত্রটি দিয়ে পোস্টার ছাপিয়ে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এই পোস্টার চিত্রটি পাকিস্তানি বর্বর সেনাবাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দালালদের বিরুদ্ধে অর্থাৎ রাজাকারদের বিরুদ্ধে জনগণের মধ্যে ঘৃণা ও দ্রোহ বাড়িয়ে দেয় বহুগুণে। এ ধরনের আরও অনেক পোস্টার তিনি এঁকেছিলেন।

তার এমন একটা পোস্টারের উপরিভাগে স্লোগান লেখা রয়েছে- ‘রক্তের ঋণ রক্তে শুধবো, দেশকে এবার মুক্ত করবো’। এ ছাড়াও ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’, ‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব’, ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো’, ‘মুক্তিবাহিনী আপনার পাশেই আছে’- বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও প্রচার দপ্তর থেকে প্রচার করা হয়। এগুলো প্রচ-ভাবে নাড়িয়ে দেয় বীর বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের। এ সময় বরেণ্য চিত্রশিল্পী আমিনুল ইসলাম মুক্তিযুদ্ধের অগণিত শহীদ নর-নারীর নির্মম নারকীয় হত্যাকাণ্ড নিয়ে ‘গণহত্যা’ শিরোনামে একটি বড় তৈলচিত্র নির্মাণ করেন; যাতে দেখা যাচ্ছে অগণিত নর-নারীর কঙ্কাল স্তূপীকৃত হয়ে আছে। উপরের দিকে বাংলার সবুজ শ্যামল পটভূমি দেখে মনে হয় শহীদদের স্মরণে বাংলাদেশ বিলাপ করছে।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে অপেক্ষকৃত তরুণ শিল্পী রফিকুন নবী ঢাকায় অবরুদ্ধ ছিলেন। যুদ্ধের ৯ (নয়) মাস আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে বিজয়ের আকাক্সক্ষা করেছেন প্রতিটি মুহূর্তে। এ ভাবনা থেকেই আঁকেন ‘বিজয়’ নামের চিত্রটি। ১৯৭১ সালের আগস্টে এই চিত্রটির কাজ শুরু করেন আর শেষ করেন ১৬ ডিসেম্বর। এই ছবিটিতে বিজয়ের মাহাত্ম্য বোঝাতে প্রতীক হিসেবে তিনি হাতির ফিগার ব্যবহার করেছিলেন। চিত্রকলা যে প্রতিবাদের অনেক বড় হাতিয়ার হতে পারে এবং অবদান রাখতে পারে ‘বিজয়’ তারই প্রমাণ।

মুক্তিযুদ্ধের সেই নারকীয় সময়ে শিল্পীদের আঁকা যেসব পোস্টার এখনো আমাদের দ্রোহ ও চেতনায় উজ্জীবিত করে তার মধ্যে দেবদাস চক্রবর্তীর আঁকা ‘বাংলার হিন্দু, বাংলার খ্রিষ্টান, বাংলার মুসলমান, আমরা সবাই বাঙালি’, প্রাণেশ ম-লের আঁকা ‘বাংলার মায়েরা মেয়েরা, সকলেই মুক্তিযোদ্ধা’, শিল্পী নিতুন কুণ্ডুর ‘সদা জাগ্রত বাংলার মুক্তিবাহিনী’ খুবই উল্লেখযোগ্য।

চিত্রশিল্পী স্বপন চৌধুরীর যুদ্ধটা আরও ভিন্ন রকমের। তারা শিল্পীরা একত্রিত হয়ে তখন শরণার্থী শিবির ও মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটিতে ঘুরে ঘুরে উদ্দীপনামূলক গান গেয়ে সবাইকে উজ্জীবিত করতেন। এ কাজটি মুক্তিযুদ্ধে ভিন্ন মাত্রার শৈল্পিক প্রচেষ্টার দাবি রাখে। মার্কিন চলচ্চিত্রকার লেভিন লেয়ারের রুপালি ফিতায় যারা এক সময় গ্রন্থিত হন। তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদের ‘মুক্তির গান’ চলচ্চিত্রে যেটা মূল উপজীব্য হয়ে ওঠে। শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী তার ক্যানভাসে তুলে এনেছেন একাধিক প্রতিবাদী গণসংগ্রাম এবং আবহমান বাংলায় হানাদারদের আক্রমণের ছবি। তবে সবকিছুর মধ্যে উপেক্ষিত থেকেছেন মুক্তিযুদ্ধকালীন পতাকার ডিজাইনার শিল্পী শিব নারায়ণ দাস।

দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম গণহত্যা, অত্যাচার তুলে ধরে চিন্তামণি কর ও কামরুল হাসানের নেতৃত্বে কলকাতার বাংলাদেশ শিল্পী-সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী সহায়ক সমিতির সহায়তায় ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ বিড়লা একাডেমিতে চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। উদ্বোধন করেন প্রখ্যাত ভাস্কর শ্রী দেবীপ্রসাদ রায় চৌধুরী।

মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাসের স্মারক নির্মাণ করেছেন আমাদের দেশের দেশপ্রেমিক শিল্পীরা। মুক্তিযুদ্ধে একজন সশস্ত্র যোদ্ধার কাজ তারা করেছেন তুলি-কলম-রঙের বর্ণিল আঁচড় দিয়ে। মাতৃভূমির প্রতি, দেশের মানুষের প্রতি দায় তারা পালন করেছেন সর্বাত্মকভাবে। তাদের এই দায়বদ্ধতার ইতিহাস সঠিকভাবে সংরক্ষণ করলে এই প্রজন্ম জানবে শিল্পীর স্বাধীনচেতা স্বভাব ও মাটি মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা। যার মধ্যে নিহিত রয়েছে শিল্পের রাজনীতি। শিল্পকলার বিকাশে শিল্পীর দায়বদ্ধতার জায়গাটার পাটাতনকে পোক্ত করার বিকল্প নেই।

পোস্টটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটেগরিতে আরো খবর
Japan Bangla Press © 2023. All Rights Reserved.
Built with care by Pixel Suggest